Review of Durgo Rawhoshyo Web Series

পর্দায় বই পড়ার স্মৃতি উস্কে দেয় ‘দুর্গ রহস্য’, সৃজিতের ব্যোমকেশ বাকিদের চেয়ে কতটা আলাদা?

সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘দুর্গ রহস্য’-তে শেষ বার ব্যোমকেশ হিসাবে পর্দায় হাজির অনির্বাণ ভট্টাচার্য। যে গল্পে কয়েক মাস আগেই ব্যোমকেশ রূপে দেবকে দেখেছে দর্শক।

Advertisement
পৃথা বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৩ ১৯:৩৬
Review of Srijit Mukherjee’s Byomkesh web series Durgo Rawhoshyo with Anirban Bhattacharya, Sohini Sarkar and Rahul Banerjee

অনির্বাণ ভট্টাচার্য-রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

বাংলা সিনেমায় প্রচুর ব্যোমকেশ। সকলেই ফিরে ফিরে আসে। তবে সৃজিত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, তাঁর ব্যোমকেশ ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি বানানোর খুব একটা ইচ্ছা নেই। কিন্তু শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুর্গ রহস্য’ উপন্যাসটি তাঁর ভীষণ প্রিয়। তাই বানালে এই একটি গল্প নিয়েই তিনি ব্যোমকেশ বানাবেন। এই গল্পের প্রেক্ষাপট এতটাই বৃহৎ এবং চরিত্ররা এতই জটিল যে, পরিচালকের এমন ইচ্ছা হওয়াই স্বাভাবিক। ‘হইচই’-এর নতুন সাহিত্য নির্ভর সিরিজ় ‘বেস্ট অফ বেঙ্গল’-এর প্রথম ওয়েব সিরিজ় হিসাবে তাই সৃজিত এই গল্পই বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর ছয় পর্বের ‘দুর্গ রহস্য’ দেখলেই বোঝা যাবে, তাঁর মূল গল্পটি কতখানি প্রিয়। সময়কাল নিয়ে একটু অদলবদল ছাড়া শরদিন্দুর লেখা থেকে খুব বেশি সরে আসেননি তিনি। সাম্প্রতিক কালে যে যে ব্যোমকেশ তৈরি হয়েছে বড় পর্দায় বা ওটিটি-তে, তার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গল্পকে নিজের মতো করে গড়ে তুলেছেন নির্মাতারা। তার কিছু কিছু দেখতে মন্দ লাগে না। আবার কিছু কিছু অহেতুক বদল মনে হয়েছে। সেই ভিড়ে ‘টেক্সট’-এর এত কাছাকাছি একটি ব্যোমকেশ দেখতে মন্দ লাগে না।

Advertisement
‘দুর্গ রহস্য’ ওয়েব সিরিজ়ের একটি দৃশ্য।

‘দুর্গ রহস্য’ ওয়েব সিরিজ়ের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।

এই ব্যোমকেশকে থ্রিলারের বদলে ড্রামা বলাটাই বেশি শ্রেয়। অনির্বাণের ভট্টাচার্য অভিনীত ‘ব্যোমকেশ ও পিঁজরাপোল’-এর ট্রিটমেন্টে যে থ্রিলারের আমেজ ছিল কিংবা কয়েক মাস আগে দেবের ‘ব্যোমকেশ ও দুর্গ রহস্য’-এ যে অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ ছিল, তা এখানে নেই। বরং রয়েছে ‘স্লো বার্ন’ ট্রিটমেন্ট। পর্দায় উপন্যাস পড়ার যে শান্ত অনুভূতি হয়, এখানেও সেটাই মিলবে। চশমা ছাড়া ব্যোমকেশ, ছাতার প্রতি ব্যোমকেশের দুর্বলতার মতো ছোটখাটো টুকিটাকি বার বার মূল গল্পের কথা মনে করিয়ে দেবে। পরিচালক যদিও তাঁর গল্পের সময় সিপাহি বিদ্রহ থেকে নকশাল আন্দোলনের সময় পর্যন্ত ধরেছেন, তবে এই নতুন সময়কাল প্রাসঙ্গিক শুধু ব্যোমকেশের ‘এন্ট্রি’ দৃশ্যেই। তা ছাড়া, বাকি গল্পে সে ভাবে প্রভাব ফেলেনি। পরিচালক চিত্রনাট্য যে ভাবে সাজিয়েছেন, সেখানে ব্যোমকেশ-অজিতের পাশাপাশি দর্শকও একটু একটু করে রহস্যের সূত্র পেতে পেতে যাবেন। ক্লাইম্যাক্সে ব্যোমকেশ যখন রহস্যের সমাধান করছে, তখন দর্শকও কিছু কিছু তথ্য পেয়ে গিয়েছেন। শুধু শেষ কিছু সুতোর গিঁট খুলে দেয় ব্যোমকেশ। খুব টান টান উত্তেজনা নেই চিত্রনাট্যে, তবে অবসরে বই পড়ার স্মৃতি (স্মৃতি বলাই ভাল! কারণ, কত জন আর বই পড়েন এখন) ফিরিয়ে দেবেন পরিচালক।

(বাঁ দিক থেকে) অনির্বাণ ভট্টাচার্য, সোহিনী সরকার এবং রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়।

(বাঁ দিক থেকে) অনির্বাণ ভট্টাচার্য, সোহিনী সরকার এবং রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

তবে যেখানে সৃজিত খানিকটা ‘সিনেম্যাটিক লিবার্টি’ নিয়েছেন, সেই জায়গাগুলিই এই সিরিজ়ের সেরা সম্পদ হয়ে উঠেছে। তার মধ্যে অন্যতম, ব্যোমকেশ-অজিত-সত্যবতীর সম্পর্ক। গল্পে তিনি সত্যবতীকে রেখেছেন। কারণ, তাঁর সত্যবতী কিছুতেই বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার পাত্রী নয়। অন্তঃসত্ত্বা বলে ঘরে বসে থাকা মোটেই তার ধাতে নেই। সে যথেষ্ট স্পষ্টবক্তা, নারীবাদী এবং তদন্তের প্রতি পদে সক্রিয়। একসঙ্গেই সে দুরন্ত প্রেমিকা, অভিমানী স্ত্রী এবং খুনসুটি করা বন্ধু। ব্যোমকেশ-সত্যবতী-অজিতের ত্রিকোণ রসায়ন এতই মিষ্টি যে, তারা পর্দায় থাকলে দর্শকের ঠোঁটে একটা স্মিত হাসি ফুটে উঠবেই। তিন জনের বন্ধুত্ব ছাড়াও যে জায়গাটা সৃজিত নিজের মতো বদলেছেন, তা হল গল্পের সময়কাল। নকশাল আন্দোলনের টুকটাক উল্লেখ রয়েছে চিত্রনাট্যে। কিন্তু তা খুব সীমিত। তবে এই সময়টা ধরায় ব্যোমকেশের এন্ট্রি সিকোয়েন্স তৈরি করতে সুবিধা হয়েছে পরিচালকের। ব্যোমকেশ-সত্যবতী-অজিত মিলে সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ দেখতে গিয়েছে। দেবের ‘ব্যোমকেশ ও দুর্গ রহস্য’ ছিল অনেক বেশি গ্র্যান্ড। বৃহত্তর দর্শকসংখ্যা ধরার জন্য ব্যোমকেশকে যতটা নায়কসুলভ দেখাতে হত, তা-ই দেখানো হয়েছিল। এখানে সৃজিত এই একটি সিকোয়েন্স দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁর ব্যোমকেশ সিরিজ়ের মুড কী রকম হতে চলেছে। পরিচালনার গুণে এখানেও ব্যোমকেশ যথেষ্ট নায়কসুলভ। কিন্তু তার জন্য কোনও রকম অতিরঞ্জিত সিকোয়েন্সের প্রয়োজন পড়েনি। তৃতীয় যে জায়গায় পরিচালকের সিগনেচার স্টাইল চোখে পড়ে, তা হল সিরিজ়ের শেষের চমক।

এই সিরিজ়ে ব্যোমকেশ, সত্যবতী এবং অজিতের ভূমিকায় অনির্বাণ ভট্টাচার্য, সোহিনী সরকার এবং রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় দর্শকের জন্য সেরা প্রাপ্তি। তবে দেবেশ রায়চৌধুরী (রামকিশোরের চরিত্রে), বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় (ঈশানচন্দ্রের চরিত্রে) এবং অনুজয় ভট্টাচার্যের (রমাপতির চরিত্রে) অভিনয় দেখার খুব বেশি সুযোগ দেয়নি চিত্রনাট্য। এখানে সব পার্শ্বচরিত্রের গঠনই খুব পাকা নয়। উপন্যাস পড়ে প্রত্যেকটি চরিত্রের যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা সিরিজ়ে ফুটে ওঠে না। তবে দেবরাজ ভট্টাচার্যের (মণিলালের চরিত্রে) অভিনয় অল্প সময়ের জন্য় হলেও মনে দাগ কেটেছে। বিশেষ করে, ক্লাইম্যাক্সের তাঁর হাসিটা বহু দিন মনে থাকবে।

তিন জনের সম্পর্ক এই সিরিজ়ে যে ভাবে দেখানো হয়েছে, তাতে ত্রয়ীর উপর একটা মায়া পড়ে যেতে বাধ্য। এখানে রাহুল অনির্বাণের রসায়ন যত ভাল, অনির্বাণ-সোহিনীরও ততটাই। এবং একসঙ্গে সোহিনী-রাহুলের রসায়নও মনে থেকে যাবে। সোহিনীকে আগেও সত্যবতী রূপে দর্শক দেখেছেন। কিন্তু তাঁর এই সত্যবতীই দর্শকের মন সবচেয়ে বেশি ছুঁয়ে যাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ‘তুমি এমনি এমনি এসো’ গানের দৃশ্যায়ন সৃজিতের পক্ষেই ভাবা সম্ভব। তবে, সোহিনী-অনির্বাণের জুটিকে এই গানে দেখে মনে হবে, পর্দায় বার বার এই জুটি ফিরে আসুক।

অনির্বাণ জানিয়েছেন, এটাই তাঁর শেষ ব্যোমকেশ। ব্যোমকেশ হিসাবে তাঁকে বহু দর্শক পছন্দ করেন। তবে শেষ বার তিনি এমন অভিনয় উপহার দিয়ে গেলেন যে, দর্শক নিশ্চয়ই চাইবে তিনি আবার ফিরে আসুন। ভক্তদের চাহিদায় শার্লক হোম্‌সকেও ফিরতে হয়েছিল। এই সত্যান্বেষী ভক্তদের ফেরাবেন না কি নিজে ফিরবেন, তা দেখা যাক।

আরও পড়ুন
Advertisement