৩০ নভেম্বর বুধবার জিতের ৫২তম জন্মদিন। চলতি বছরেই টলিপাড়ায় ২০ বছর সম্পূর্ণ করেছেন টলিউডের ‘বস’। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
শুরুতেই কয়েক দশক পিছিয়ে যাওয়া যাক। টলিপাড়ায় তখন বাণিজ্যিক ছবির রমরমা। দাপটের সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রি শাসন করছেন প্রসেনজিৎ, চিরঞ্জিৎ। পারিবারিক নাটকীয়তা এবং ভাল-খারাপের দ্বন্দ্ব নিয়ে চলতে থাকা বাংলা ছবি এবং তার নায়কের ভিড়ে হাজির হল একটা নতুন মুখ। সৌম্যদর্শন চেহারা। গায়ের রং ফরসা। অবাঙালি, কিন্তু ছেলেটা বাংলা বলে ভাল। প্রথম ছবি ‘সাথী’ বক্স অফিসে সুপারহিট। কালীঘাটে বড় হওয়া জিতু মদনানীকে বাংলা ইন্ডাস্ট্রি চিনল জিৎ নামে। বাকিটা ইতিহাস। ৩০ নভেম্বর বুধবার জিতের ৫২তম জন্মদিন। চলতি বছরেই টলিপাড়ায় ২০ বছর সম্পূর্ণ করেছেন টলিউডের ‘বস’।
শুরু থেকে জিতের সফরটা কিন্তু সহজ ছিল না। অবাঙালি হয়ে বাঙালি-শাসিত ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের জায়গা করে নেওয়া কতটা কঠিন? উত্তরে আনন্দবাজার অনলাইনকে জিৎ বলেছিলেন, ‘‘শুরুর ওই দিনগুলোকে স্ট্রাগল না বলে আমি একটা পদ্ধতি হিসেবে দেখি। প্রত্যেকেই তার জীবনে এ রকম একটা অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে এগোতে হয়।’’
ইন্ডাস্ট্রিতে জিতের প্রথম ছবি হরনাথ চক্রবর্তীর পরিচালনায়। এক টানা ২৫ সপ্তাহ ১৮ থেকে ৪০টা প্রেক্ষাগৃহ, দিনে ৩টে শো— হাউসফুল! বর্তমানের টলিপাড়ায় যা এক কথায় অকল্পনীয়। ‘সাথী’র কাস্টিং কী ভাবে হয়? হরনাথ বললেন, ‘‘প্রযোজকের সঙ্গে ছবিটা নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখন এন টি ওয়ান স্টুডিয়োতে ‘প্রতিবাদ’ ছবির শুটিং করছি। আমরা নতুন মুখ খুঁজছিলাম। তারও এক- দেড় বছর আগে জিৎ আমার কাছে ওর ছবি দিয়ে গিয়েছিল। আমার সহকারী ওর ছবিটা খুঁজে বার করে। তার পর ফোন করে ওকে ডাকা হল।’’ আর প্রস্তুতি পর্ব? পরিচালক বললেন, ‘‘অমিতাভ বচ্চনের জনপ্রিয় সংলাপগুলো জিৎ খুব সুন্দর করে অভিনয় করে শোনাত। আমি বুঝে গিয়েছিলাম, ও পারবে। তার পর ফটোশুট হল। চিত্রনাট্য নিয়ে ওর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা।’’
প্রথম ছবি। সেখানে ভুলভ্রান্তি থাকাটা স্বাভাবিক। হরনাথের কথায়, ‘‘কিন্তু অনেকেই জানেন না, এনটি ওয়ান স্টুডিয়োর দোতলা থেকে লাফাতে হবে। নিজে করল। কাচ ভাঙ্গার দৃশ্য। বার বার বারণ করা সত্ত্বেও নিজে করল। তার পর হাত কেটে রক্ত! বলত, ‘তুমি শুধু বল কী করতে হবে।’ এই হচ্ছে জিৎ। এই হল ওর ডেডিকেশন।’’
এর পর ‘চ্যাম্পিয়ন’, ‘নাটের গুরু’, ‘সঙ্গী’ হয়ে ‘বন্ধন’ ও ‘শুভদৃষ্টি’— পর পর হিট ছবি দিলেও নায়কের পথচলা কিন্তু সহজ ছিল না। ‘সাথীহারা’, ‘প্রিয়তমা’, ‘ঘাতক’ এর মতো ছবি বক্স অফিসে সেই অর্থে ব্যবসা করতে পারেনি। সাফল্য ও ব্যর্থতার প্রসঙ্গেই জিৎ আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছিলেন, ‘‘সমালোচনা বা ভুলগুলোকে আগে জেনে শুধরে নিতে চাই। সব সময় চেষ্টা করি নিজেকে কী ভাবে আরও ভাল তৈরি করতে পারি।’’ হয়েওছিল তাই। ‘ওয়ান্টেড’ সেই অর্থে জিতের কেরিয়ারের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট। পাশের বাড়ির মিষ্টি ছেলের ‘স্টিরিয়োটাইপ’ থেকে তাঁর অ্যাকশন অবতার পছন্দ হল দর্শকের। এর পরেই দেবের সঙ্গে জুটি বেঁধে ‘দুই পৃথিবী’। দুই সুপারস্টারকে বড় পর্দায় দেখতে প্রক্ষাগৃহ ভরিয়েছিলেন দর্শক। কারও সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কোনও দিন বিশ্বাস করেননি বাংলার এই তারকা। প্রশ্ন উঠলেই বলেছেন, ‘‘আমি নিজেই আমার প্রতিযোগী।’’
‘ওয়ান্টেড’ ছাড়াও রবি কিনাগির একাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন জিৎ। পরিচালক বললেন, ‘‘এখনও ও আমাকে দাদার মতো সম্মান করে। শুরু থেকে পরিশ্রম করতে ভয় পায়নি বলেই আজকে জিৎ এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।’’ পরিচালকের কাছে একাধিক উদাহরণ রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘ফাইটার ছবির সময় কাজের প্রতি ওর জেদ দেখে অবাক হয়েছিলাম। চরিত্রের প্রয়োজনে তখন ও কড়া ডায়েটে। শুটিংয়ের ফাঁকে আমরা সবাই বসে ভাল ভাল খাবার খাচ্ছি। কিন্তু জিৎকে হাসিমুখে সিদ্ধ খাবার খেতে দেখেছিলাম।’’ রবি কিনাগির বিশ্বাস, ইচ্ছাশক্তি আর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে তারকা হওয়া যায় না। আর জিৎ তার অন্যতম উদাহরণ।
বিগত দশ বছরে বাংলা ছবির ধারা বদলেছে। বাণিজ্যিক ছবির ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে ‘অন্য ধারা’র ছবি। জিৎ কিন্তু তাঁর দর্শনে অবিচল। আনন্দবাজার অনলাইনেই নায়ক বলেছিলেন, ‘‘আমি সব ধরনের ছবি দেখতে পছন্দ করি। কিন্তু তা সত্ত্বেও লার্জার দ্যান লাইফ বা বড় মাপের ছবি আমাকে বেশি আকর্ষণ করে, যেটা সব বয়সি দর্শক দেখতে পারবেন।’’ অভিনেতার এই দর্শনকে সমর্থন করেন রবি কিনাগি। তাঁর কথায়, ‘‘বাণিজ্যিক ছবি আর হচ্ছে না বলেই তো বাংলায় একের পর এক সিঙ্গল স্ক্রিন বন্ধ হচ্ছে। সেখানে এখনও বাণিজ্যিক ছবির প্রতি ওর বিশ্বাসকে আমি সম্মান করি। ভাল লাগে, ‘বাণিজ্যিক’, ‘মশালা’ ছবির পাশে অন্তত কেউ তো রয়েছেন।’’
সাম্প্রতিক অতীতে ছবি নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজেকে কিছুটা হলেও বদলানোর চেষ্টা করেছিলেন জিৎ। তাকিয়ে ছিলেন অন্য ধারার ছবির দিকে। কিন্তু এই ‘এক্সপেরিমেন্ট’ অনেক আগেই করা হয়েছিল। মনে করিয়ে দেওয়া যাক, সেই ছবির নাম ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’। জিৎ ও স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় জুটি। ছবির পরিচালক রাজা সেন বললেন, ‘‘বাণিজ্যিক ছবি করলেও এই ছবির জন্য জিৎকেই তখন আমার উপযুক্ত মনে হয়েছিল। সুন্দর চেহারা, ভাল অভিনয় করে। তা ছাড়া বণিজ্যসফল ছবির নায়ককে অন্য ধারার ছবিতে আনতে পারলে তো উভয় ঘরানারই লাভ। তাই ওকে প্রস্তাব দিতেই রাজি হয়ে যায়।’’ তবে ছবির জন্য জিৎ যে ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন সেটা অনেকের কাছেই শিক্ষণীয় বলে মনে করেন রাজা।
বললেন, ‘‘বঙ্কিমী বাংলা। দীর্ঘ দিন আমার সঙ্গে ওয়ার্কশপ করেছিল জিৎ। ডাবিংয়ের সময়েও মারাত্মক পরিশ্রম করেছিল। ওর কাজে আমি সন্তুষ্ট।’’
‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এর হাত ধরে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল সাম্প্রতিক অতীতে ‘বাচ্চা শ্বশুর’ বা ‘অসুর’-এর মতো ছবি তাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু দর্শকের মধ্যে ছবি ঘিরে তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। আবার যখন ‘রাবণ’-এ ফিরলেন জিৎ, দর্শক ফিরে পেলেন তাঁদের পুরনো ‘বস’কে। অনুরাগীরাই কি প্রিয় অভিনেতাকে এক্সপেরিমেন্ট করতে দেখে স্বচ্ছন্দ নন? প্রশ্নটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
আর ইন্ডাস্ট্রিতে কুড়ি বছর পার করা জিতের সাফল্যের রহস্য কী? হরনাথের কথায়, ‘‘ শুরু থেকে ও একটু আড়ালে থাকতে পছন্দ করে। সব জায়গায় গিয়ে হাজির হয় না। সুপারস্টার তৈরিই হয় তাঁর প্রতি মানুষের বাড়তে থাকা কৌতূহল থেকে। আমার মনে হয়, জিৎ সেটা খুব ভাল ভাবে ধরে রাখতে পেরেছে।’’
‘চেঙ্গিজ’ নিয়ে আবার পরিচিত অবতারেই বড় পর্দায় ফিরবেন জিৎ। অপেক্ষায় দর্শক। বুধবার সকালে ভক্তদের সঙ্গে কেক কাটবেন তিনি। অন্যান্য দিনের মতোই নিজের প্রযোজনা সংস্থার অফিসে যাবেন। বাকি সময়টা কাটাবেন পরিবারের সঙ্গে। সুপারস্টার হয়েও তাই কোথাও যেন তিনি আলাদা।