Ramprasad Ki Tehrvi

রামপ্রসাদ কি তেহরভি: শুধু অভিনয়ের জন্যই এ ছবি দেখা যায়

সীমা পাহওয়ার স্মরণীয় অভিনয়ের পরে ওঁর প্রথম পরিচালনায় 'রাম প্রসাদ কি তেহরভি' দেখার আগে তাই প্রত্যাশা ও কৌতূহলের সঙ্গে খানিক উত্তেজনাও কাজ করছিল।

Advertisement
ইন্দ্রদত্তা বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২১ ১৯:৫৭
 'রামপ্রসাদ কি তেহরভি'।

'রামপ্রসাদ কি তেহরভি'।

অভিনয় জগতে সাফল্য ও খ্যাতির পর পরিচালনায় হাত দিলে সব সময়েই দর্শকের মধ্যে একটা প্রত্যাশা ও কৌতূহল কাজ করে। 'আঁখো দেখি' বা 'বরেলি কি বরফি'-র মতো অন্য রকম ছবিতে সীমা পাহওয়ার স্মরণীয় অভিনয়ের পরে ওঁর প্রথম পরিচালনায় 'রামপ্রসাদ কি তেহরভি' দেখার আগে তাই প্রত্যাশা ও কৌতূহলের সঙ্গে খানিক উত্তেজনাও কাজ করছিল। উত্তেজনার আর একটি বড় কারণ ছিল এই ছবির কাস্ট। ১৯৭০-'৮০র দশকে সমান্তরাল ভারতীয় ছবির ধারা থেকে নাট্যজগৎ- সীমা বেছেছেন সুপ্রিয়া পাঠক, নাসিরুদ্দিন শাহ, কঙ্কনা সেনশর্মা এবং পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের মতো দাপুটে অভিনেতাদের। ২৭ জন অভিনেতাকে নিয়ে এই ছবির অনসম্বল কাস্ট তাই প্রথমেই প্রত্যাশার পারদ চড়িয়ে দেয় বহুমাত্রায়।

সিনেমার শুরুর দৃশ্যে দেখা যায়, রাত্রির নীলাভ অন্ধকার আর ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় মায়াবি এক নির্জন গলি। এই পথ ধরে ক্যামেরা এগিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ ঢুকে পড়ে বাঁ দিকে একটি বাড়িতে, এবং প্যান করে দেখাতে থাকে বাড়ির অন্দরমহল, যেখান থেকে ভেসে আসছে পিয়ানোয় অদ্ভুত মন কেমন করা সুর। ক্যামেরা এসে বেডরুমে থামলে দেখা যায় একটি ছেলে আপন মনে পিয়ানো বাজাচ্ছে, খুঁজে পাওয়া যায় এই মনকেমনিয়া সুরের উৎস। শুরুতেই ক্যামেরার এই চলনে একটা ঝাঁকুনি লাগে, মনে হয় যেন দর্শকই এই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ঢুকে পড়েছেন একটি বাড়ির অন্দরমহলে। সচেতন ভাবেই ক্যামেরা হয়ে ওঠে একটি জীবন্ত চোখ, একটি চরিত্র।

সাগর দেশাইয়ের সঙ্গীত পরিচালনায় এই দৃশ্যে এক অদ্ভুত দোদুল্যমানতা ছিল, কারণ রাত্রি এবং পিয়ানোর সুর যেখানে এক দিকে তৈরি করেছে একটা রহস্যময় পরিবেশ, আবার তার পরেই রামপ্রসাদ ও তার স্ত্রীর এক ঝলক দাম্পত্য কলহ দিচ্ছে সামান্য কমেডির ইঙ্গিত। প্রথমে এই দ্বন্দ্ব আকৃষ্ট করলেও, ছবি এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় কৌতুক, আবেগ, নৈতিকতা- সমস্ত কিছুর মিশ্রণ ঘটাতে গিয়ে কোনওটাই ঠিক মতো প্রকাশিত হতে পারেনি। ছবির আরম্ভের এই মজাটা তাই ছবি শেষের অনেক আগেই হারিয়ে যায়।

রামপ্রসাদের আকস্মিক মৃত্যু এই ছবির পটভূমি, যা বহুদিন পরে নিজ নিজ পরিবারসহ তার ৪ পুত্র ও ২ কন্যাকে আবার ফিরিয়ে আনে তাদের পৈতৃক বাড়িতে। আলাদা করে কোনো গল্প বা প্লট নেই, মূলত বাউজির মৃত্যু পরবর্তী ১৩ দিনের শোকপালনের সময় বিভিন্ন ছোট ছোট ঘটনা ও পরিবারিক টানাপড়েন নিয়েই এই ছবি। আলাদা জায়গা ও অবস্থান থেকে উঠে আসা এতগুলো মানুষের সহাবস্থানে পুরনো দিনের স্মৃতিচারণার পাশাপাশি নিরন্তর লেগে রয়েছে খটাখটি, ঝগড়া, আপস ও মান-অভিমান। কোনো চরিত্রই নিখুঁত নয়— কখনও পুরনো ধার দেনার হিসেব নিয়ে স্ত্রীদের মধ্যে তিক্ততা তৈরি হচ্ছে, আবার অন্য দিকে নাতি নাতনিরা মিলিত হওয়ার কারণ ভুলে গিয়ে ভুল সময়ে আনন্দে মাতছে। এই সব চোখে পড়ায় শোকে বিধ্বস্ত সদ্য বিধবা হওয়া আম্মা আরও ভেঙে পড়ছেন, অসহায় হয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাঝরাতে মেয়ের কাছে প্রকাশ করছেন তাঁর দোটানা- সব সময় সকলে মিলে একসঙ্গে থাকার স্বপ্ন দেখে এসেও, সবাই বাস্তবে একত্রিত হওয়ার পর কেন তাঁর এত একা লাগছে, তিনি বুঝতে পারেন না।

এতগুলি চরিত্রকে একসঙ্গে এনে কাজ করা সত্যিই এক চ্যালেঞ্জ। তবে এ ধরনের অন্য ফ্যামিলি ড্রামা- উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে এই ছবিরই এক অভিনেত্রী কঙ্কনা সেনশর্মার 'ডেথ ইন দ্য গঞ্জ' বা রজত কপূরের 'আঁখো দেখি'-র মতো সূক্ষ্মতা এ ছবিতে চোখে পড়ে না। সীমার নিজেরই লেখা 'পিণ্ডদান' শীর্ষক একটি নাটক থেকে তৈরি হয়েছে এই ছবির চিত্রনাট্য, ফলে নাট্যমঞ্চের প্রভাব প্রথম থেকেই চোখে পড়ে। কিন্তু সিনেমা ও নাটক— এই দু'টি ফর্মের মূলগত পার্থক্যের জন্যই নাটকের অধিক প্রভাব এই ছবির সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

কিছু কিছু দৃশ্য ছবির শেষেও মনে থেকে যায়। যেমন আম্মার ঘুমের সুযোগ নিয়ে বাড়ির ছেলেরা বা নাতি-নাতনিরা রাতে কী করে তা আম্মার দেখে ফেলার দৃশ্য, বা কঙ্কনা সেনশর্মা ও বিক্রন্ত মাসের মধ্যে একটি দৃশ্য। শেষের এই দৃশ্যটি দু'জন অসাধারণ অভিনেতার গুণেই স্মরণীয় হয়ে যায়। আম্মার ভূমিকায় একটা দুটো দৃশ্য ছাড়া সুপ্রিয়া পাঠকের সংযত ও ধীর-স্থির অভিনয় নজরকাড়া। ছোট ছেলে নিশান্তের ভূমিকায় পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ও বড় ছেলে গজরাজের ভূমিকায় মনোজ পাহওয়াকে ভালো লাগে। তবে মনোজের মা হিসেবে বয়সের দিক থেকে সুপ্রিয়া যেমন বিশ্বাসযোগ্য নন, তেমনই বিক্রন্ত মাসের চাচা হিসেবে পরমব্রতও ঠিক মাননসই নন। বরং, যৌবনকালের রামপ্রসাদের ভূমিকায় বেশ মানিয়েছে পরমব্রতকে। অন্যান্য ভূমিকায় ভালো লাগে বিনয় পাঠক, দীপিকা আমিন ও ব্রিজেন্দ্র কালাকে। রামপ্রসাদের চরিত্রে নাসিরুদ্দিনের উপস্থিতি ক্ষণিকের হলেও তা প্রত্যাশিত ভাবেই মনে থেকে যায়।

ফ্যামিলি ড্রামায় সব সময়েই একটা সম্ভাবনা থাকে তার চিত্রায়ন একপেশে হয়ে পড়ার এবং নৈতিক উচিত-অনুচিতের বাইনারি তৈরি করার। কৌতুক ও হাস্যরসের ব্যবহারে তা অনেকটা এড়ানো গেলেও, যেহেতু অনেক দৃশ্যেই আবেগের সুড়সুড়ি ও পারিবারিক মূল্যবোধ বেশি গুরুত্ব পায় তাই এই সম্পূর্ণ সম্ভাবনা এড়ানো যায়নি। এর ফলে কিছু সমস্যাজনক স্টিরিওটাইপকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলে এই ছবি। যেমন, শাশুড়ির আবেগতাড়িত গলায় 'থ্যাঙ্ক ইউ' ও 'সরি' বলার গুরুত্ব নিয়ে জ্ঞান দেওয়া শুনে ফেলে নিশান্তের স্ত্রী সীমাকে হঠাৎ দেখা যায় তার গর্ভপাতের সিদ্ধান্তে অনুতাপ প্রকাশ করতে, বা পরের দিন সিঁদুর ও টিপ পরে সতীসাধ্বী হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে।

ছবির আরেকটি সমস্যা দৈর্ঘ্য। দ্বিতীয়ার্ধে হঠাৎ গতি এত শ্লথ হয় যে ধৈর্যচ্যূতি ঘটে। 'ডেথ ইন দ্য গঞ্জ' এবং 'আঁখো দেখি'-তে অসাধারণ কাজের পর এই ছবিতে সাগর দেশাইয়ের সঙ্গীত পরিচালনা তেমন উল্লেখযোগ্য মনে হয় না। পিয়ানো এ ছবির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, তাকে আরও বেশি করে ব্যবহার করার পরিসর ছিল যা অধরা থেকে যায়। গানগুলিও বেশির ভাগ মনে রাখার মতো নয়, তবে আবহ হিসেবে ভাল লাগে। এত কিছুর মধ্যেও এ ছবির অন্যতম রসদ অভিনয়। কেবল অভিনয় দেখার জন্যই ভরসা করে এক বার এই ছবি দেখা যেতে পারে।

Advertisement
আরও পড়ুন
Advertisement