ঐন্দ্রিলা-সব্যসাচীর প্রেমের কাহিনি। ফাইল চিত্র।
সম্প্রতি একটি বাংলা ছবির একটি গান শ্রোতাদের সমাদর পেয়েছিল। ‘আমাদের গল্পগুলো অল্প সময় ঘর পাতালো...’ বলে সেই গানটি গেয়েছেন লগ্নজিতা চক্রবর্তী। ‘একান্নবর্তী’ ছবির সেই গানের আবহের সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে কোনও মিল নেই। কিন্তু এই শহরের এক ভালবাসার জুড়ির গল্পগুলোও অল্প সময়ের হয়েই রয়ে গেল। ঐন্দ্রিলা শর্মা এবং সব্যসাচী চৌধুরী। অল্প সময়ের জন্যই ঘর পাতিয়েছিল তাঁদের গল্পগুলো। কিন্তু গোটা শহর এবং সমাজে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে গিয়েছে। অনিশ্চয়তা ছিল। বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তা। কিন্তু তার পরেও প্রতিটি মুহূর্তকে ধরে রাখার, বেঁধে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা।
এ কোনও ছায়াছবির চিত্রনাট্য নয়। কোনও ‘অ্যাকশন’ নেই। ‘কাট’ নেই। শুটিং শেষের তাড়া নেই। বোধহয় তাড়া ছিল ঐন্দ্রিলার। যে শব্দটা শুনলে আপনা থেকে একটিই শব্দ আসত সব্যসাচীর ঠোঁটে— ‘আমার’। একটি সাক্ষাৎকারের ‘র্যাপিড ফায়ার’ পর্বে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “ঐন্দ্রিলা বলতেই আপনার প্রথম কোন শব্দ মাথায় আসে?” একগাল হাসি নিয়ে সব্যসাচীর উত্তর ছিল, “আমার।” মানুষ জীবন থেকে চলে গেলে কি অনুভূতিগুলোও চলে যায়? হয়তো যায়। হয়তো যায় না। সময়ের সঙ্গে সেই ক্ষতে হয়তো প্রলেপ পড়ে। হয়তো পড়ে না। মুহূর্তগুলো বেঁচে থাকে। সব্যসাচী-ঐন্দ্রিলার প্রেমকাহিনির মুহূর্তগুলো যেমন থেকে যাবে। কারণ, সেই রূপকথার সঙ্গে বাস করেছেন আরও অনেকে।
সেই অপরূপ রূপকথার সূচনা ২০১৭ সালে। ঐন্দ্রিলার প্রথম ধারাবাহিক ‘ঝুমুর’-এর সেটে প্রথম দেখা। তবে সেই দেখাতেই যে তাঁরা একে অপরকে মন দিয়ে ফেলেছিলেন, তা নয়। ‘লভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’-এ মোটেও বিশ্বাসী ছিলেন না ঐন্দ্রিলা। তা হলে কী ভাবে শুরু হল রূপকথা? শুটিং থেকে ছুটি পেলেই বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিলে আড্ডা দিতেন ঐন্দ্রিলা। থাকতেন সব্যসাচীও। তার পর ধীরে ধীরে ফোনে কথাবার্তা শুরু। তখনও ভালবাসার কথা স্বীকার করেননি কেউই। কিন্তু মনে রেখে দিয়েছিলেন। অতঃপর পৃথিবীর যাবতীয় প্রেমকাহিনির মতো সব্যসাচী-ঐন্দ্রিলার কাহিনিও গড়িয়ে গিয়েছিল ঈপ্সিত পথে।
তার পরের মোচড়, নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাত জেনেছে শহর। জেনেছে সমাজ। বিস্মিত হয়েছে। পাশে থেকেছে। মুগ্ধ হয়েছে। পরের পাঁচ বছরে বেঁচে নেওয়া বাকি যুগল জীবন।
সব্যসাচী-ঐন্দ্রিলার প্রথম ‘ডেট’ দক্ষিণ কলকাতার এক ছাদখোলা রেস্তরাঁয়। তবে তার পরের পথচলা খুব মসৃণ থাকেনি। প্রেমে থাকলে পরস্পর পরস্পরকে অনেক প্রতিশ্রুতি দেন সকলে। সব সময় পাশে থাকার, হাত না ছাড়ার! কিন্তু কালের দৈনন্দিনতায়, গতানুগতিকতায় সেই প্রতিশ্রুতি হারিয়ে যায়। কথা দিয়ে কথা রাখা কঠিন। কিন্তু ইচ্ছে থাকলে সেই কঠিন কাজও যে অনায়াসে করা যায়, তা বুঝিয়েছেন সব্যসাচী।
অনেকে মনে করেন, অনুপস্থিতিই বুঝিয়ে দেয় এক জনের জীবনে সেই ব্যক্তির মূল্য। দিল্লির হাসপাতালের ঘরে বসে সেই মূল্যটাই বুঝতে পেরেছিলেন ঐন্দ্রিলা। ২০২১ সালে দ্বিতীয় বার ক্যানসার ধরা পড়ে তাঁর। তখন সব্যসাচী ব্যস্ত ধারাবাহিক ‘সাধক বামাক্ষ্যাপা’র শুটিংয়ে। কেমোথেরাপির জন্য তড়িঘড়ি দিল্লি যেতে হয় ঐন্দ্রিলাকে। সঙ্গে যান মা-বাবা। কিন্তু তবুও যেন কিছু একটা মিস্ করছিলেন ঐন্দ্রিলা। কী? নিজেও ঠিক বুঝতে পারছিলেন না। কী যেন একটা নেই! কী যেন একটা নেই!
কী নেই, বুঝতে পেরেছিলেন হালকা গোলাপি টি-শার্ট পরে যখন হাসপাতালের ঘরে ঢুকেছিলেন সব্যসাচী। বোঝার শুরু। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যে ভাবনায় বাস করেছেন ঐন্দ্রিলা। বাস করেছেন সব্যসাচীও।
গত ৩১ অক্টোবর সব্যসাচীর জন্য শেষ লেখা লিখেছিলেন ঐন্দ্রিলা— “আমার বেঁচে থাকার কারণ।” আর সব্যসাচীর পুরো পৃথিবী জুড়েই ছিলেন ঐন্দ্রিলা। ১ নভেম্বর তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর থেকে দু’চোখের পাতা এক করেননি সব্যসাচী। জোর গলায় বলেছেন, ‘‘নিজে হাতে নিয়ে এসেছিলাম। নিজে হাতেই ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যাব।’’ পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার পরেও বিশ্বাস হারাননি তিনি। সমাজমাধ্যমে খোলা আর্জি জানিয়েছিলেন, সকলে যেন ‘অলৌকিক’-এর জন্য প্রার্থনা করেন।
সব্যসাচীর সঙ্গে সেই প্রার্থনা করেছিল বাঙালি। প্রার্থনা করেছিল সমাজ-সংসার-পারিপার্শ্বিক। প্রার্থনা করেছিল গোটা টলিউড ইন্ডাস্ট্রি। সকলেই চেয়েছিলেন ঐন্দ্রিলা আরও এক বার ফিরে আসুন। ফিরে আসুক সব্যসাচী-ঐন্দ্রিলার জুড়ি। হল না। সব সময় তো সব ইচ্ছে পূরণও হয় না। তবে কিছু কিছু কাহিনি থেকে যায়। অপরূপ রূপকথা হয়ে।