বাবা ১১ কিলোমিটার হেঁটে কাজে যেতেন। তিনি নিজে স্কুলের গণ্ডিও পেরোননি। ছোটবেলায় একই ঘরে পরিবারের সবাই মিলে থাকতেন।
কিন্তু তাতে কী! দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া সেই ছেলেই আজ দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ভারতীয় তারকাদের উপার্জন নিয়ে তৈরি ফোর্বসের ১০০-র তালিকায় ৬ বার জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। এমনকি রজনীকান্তের মেয়েকে বিয়ে করে তাঁর মতো সুপারস্টারের জামাইও হয়ে গিয়েছেন!
কার কথা বলছি? কোনও একটা পরিচয়ে তাঁকে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। তিনি একাধারে অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক, লেখক এবং সঙ্গীতশিল্পীও। খেলার ছলে গাওয়া তাঁর একটি গান এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে আন্তর্জাতিক মহলেও তার গান নিয়ে চর্চা হয়েছিল ব্যাপক।
অথচ এত প্রতিভাবানকেও প্রথম দিকে ছেড়ে কথা বলেনি ইন্ডাস্ট্রি। রূপ নিয়ে নানা কুকথা শুনতে হয়েছে তাঁকে। এক সময় বন্ধ ঘরে দিনের পর দিন মুখ গুঁজে পড়ে থাকতেন। ভেবেছিলেন ইন্ডাস্ট্রিতে আর কখনও ফিরবেন না। সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানো। এবং সেই রূপ নিয়েই সুপারস্টার হয়ে জবাব দিলেন ইন্ডাস্ট্রিকে।
ধনুষ। তামিল ছবির এই সুপারস্টারের প্রকৃত নাম ভেঙ্কটেশ প্রভু কস্তুরী রাজা। ভেঙ্কটেশ এবং প্রভু এই দুই নামেই ইন্ডাস্ট্রিতে নামজাদা লোকজন থাকায় নিজের নামই বদলে ফেলেন তিনি। একটি ছবি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই নিজের নাম রাখেন ধনুষ।
১৯৮৩ সালে এক তামিল পরিবারে জন্ম ধনুষের। বাবা কস্তুরী রাজাও আজ তামিল ইন্ডাস্ট্রির পরিচিত নাম। অথচ এক সময় তাঁর বাবাকে সংসার চালানোর জন্য ১১ কিমি হেঁটে কারখানায় কাজে যেতে হত। হেঁটে যেতেন গাড়ি ভাড়া বাঁচানোর জন্য। আর্থিক অবস্থা এমনই ছিল সংসারের।
সেই কাজ করতে করতেই তিনি ছবির গল্প লিখতেন আর নামমাত্র টাকায় গল্পগুলো বেচে দিতেন। ধীরে ধীরে নিজেকে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। বাবাকে দেখেই বোধহয় দাঁত কামড়ে পড়ে থাকতে শিখেছিলেন ধনুষ। সে কারণে কেরিয়ারের প্রথম দিকে গঞ্জনা সহ্য করেও ইন্ডাস্ট্রি আঁকড়ে পড়েছিলেন।
পড়াশোনার প্রতি কোনও দিন আগ্রহ ছিল না ধনুষের। স্কুলের গণ্ডিও পেরোতে পারেননি। পড়াশোনার প্রতি তাঁর অনীহা দেখেও ছেলেকে বিশেষ জোর করেননি কস্তুরী। বরং ২০০২ সালে নিজের পরিচালিত ‘থুল্লুভাদো ইয়ামাই’ ছবিতে ধনুষকে সুযোগ করে দেন।
একপ্রকার ঠেলে ঠেলেই ধনুষকে শ্যুটিং সেটে নিয়ে যেতেন তিনি। জীবনে প্রথম বারের জন্য ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েই কিস্তিমাত। বিপুল প্রশংসা পান কাজের জন্য। এর পরের বছরই আর একটি ছবি করেন ধনুষ।
ওই ছবিতে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়েছিলেন। এ বারেও তাঁর অভিনয় নজর কাড়ে। এই ছবি চূড়ান্ত সফল হওয়ার পরই আরও একটি ছবির প্রস্তাব পেয়ে যান তিনি। তাঁর ঝুলিতে ছবির সংখ্যা যেন কমতেই চাইছিল না। একটার শ্যুটিং হতে না হতেই আরও একটি ছবি চলে আসছিল হাতে।
অথচ ক’দিন আগেও তাঁকে কোনও পরিচালক নিজের ছবিতে নিতে চাইতেন না। এই চেহারায় নায়কের স্বপ্ন দেখায় অনেক কটূক্তি উড়ে এসেছে তাঁর দিকে। অভিনয় দেখার পরে সেই পরিচালকেরাই আবার তাঁর সময় পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেন।
মাত্র ৩৭ বছর বয়সি এই নায়ক ইতিমধ্যেই ৫০টির কাছাকাছি ছবিতে অভিনয় করে ফেলেছেন। ১৩টি সিমা অ্যাওয়ার্ড, ৯টি বিজয় অ্যাওয়ার্ড, ৭টি দক্ষিণ ফিল্মফেয়ার, ৫টি ভিকাতন অ্যাওয়ার্ড, ৫টি এডিসন, ৪টি জাতীয় পুরস্কারও এসে গিয়েছে তাঁর ঝুলিতে!
শুধু অভিনয় নয়, ধনুষ আরও কয়েক গুণ বেশি প্রতিভাবান। ধনুষের গান ‘কোলাভেরি ডি’ তাঁকে আলাদা জনপ্রিয়তা এনে দেয়। পাশাপাশি প্রযোজনা, পরিচালনাতেও যথেষ্ট নাম করেছেন।
তামিল ইন্ডাস্ট্রির পর বলিউডেও পা রাখেন তিনি। ২০১৩ সালের রোম্যান্টিক ছবি ‘রাঞ্ঝনা’ এবং তার পর ‘শামিতাভ’-এ অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে পর্দায় দেখা যায় তাঁকে।
তার পর দেশের সীমানা পেরিয়ে একেবারে হলিউডে পৌঁছন তিনি। ২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া মার্জানে সাতরাপি পরিচালিত ‘দি এক্সট্রাঅর্ডিনারি জার্নি অব দ্য ফকির’ ছবিতে উমা থরম্যান, আলেক্সান্দ্রা দাদ্দারিওর বিপরীতে কাজ করেন৷
প্রতিভাবান ধনুষকে চিনতে ভুল হয় রজনীকান্তের। ২০০৪ সালে রজনীকান্তের মেয়ে ঐশ্বর্যার সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। মেয়ের পছন্দকে প্রথম দেখাতেই সিলমোহর দিয়েছিলেন থালাইভা।
২০১৬ সালে জন্ম পরিচয় নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন ধনুষ। তামিলনাড়ুর মেলুরের এক দম্পতি কাথিরেসান এবং মীনাক্ষী দাবি করেন, ধনুষ নাকি তাঁদের ছেলে! স্কুলের পরীক্ষায় ফেল করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তিনি এবং তার পর কস্তুরী রাজার কাছে বড় হন।
সেই মর্মে আদালতে পিটিশনও দাখিল করেন তাঁরা। প্রতি মাসে খরচ বাবদ ধনুষের থেকে ৬০ হাজার টাকা দাবি করেন তাঁরা।
পরে অবশ্য প্রমাণ হয়ে যায় ওই দম্পতি মিথ্যা কথা বলছেন। ধনুষ যে তাঁদের ছেলে, তার কোনও প্রমাণই দিতে পারেননি তাঁরা।
ধনুষ-ঐশ্বর্যার দুই সন্তান। যাত্রা এবং লিঙ্গ। দুই সন্তান এবং অনুরাগীদের জন্য ২০২২ সালে আরও চমক নিয়ে হাজির হতে চলেছেন ধনুষ। ‘দ্য গ্রে ম্যান’ আরও একটি ইংরাজি ছবি মুক্তি পেতে চলেছে তাঁর।