Sandhya Mukhopadhyay

রেকর্ডিংয়ের আগে মৌনব্রত পালন করতেন সন্ধ্যাদি, জানতে পেরে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম!

দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেই আমি স্থির। সন্ধ্যাদি মৌনব্রত পালন করছেন! অহেতুক কথা বললে গলায় বাড়তি ধকল আর মনোস়ংযোগ নষ্ট হবে।

Advertisement
শুভজিৎ রায়
শুভজিৎ রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৬:১৪
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

২০০৩ । পয়লা বৈশাখের পরদিন এইচএম ভি-র ধর্মতলার অফিসে মিটিং বসল পুজোর গানের রেকর্ডিং নিয়ে। ‘পুজোর গান’ নিয়ে উদ্দীপনা তখনও বেঁচে ছিল মিউজিক সংস্থা, শিল্পী, সুরকার— সকলের মধ্যেই। মিটিং-এর মাঝখানে আমি প্রস্তাব দিলাম সন্ধ্যাদির কাছে যদি আমরা গানের অনুরোধ নিয়ে যেতে পারি। আমি তখন গ্রামাফোন কোম্পানির পূর্ব ভারতের 'A&R' ( Artist & Repertoire ) হেড। কিছু দিন আগেই সৌভাগ্য হয়েছিল এইচএমভি থেকে মান্না দে-র শেষ রেকর্ড ‘ঠিক ছবির মত’ করার। সাহসও বেড়ে গিয়েছিল তাই।

উপর মহল থেকে অনুমতি নিয়ে পৌঁছে গেলাম লেক গার্ডেন্সে। পোস্ট অফিসের গা ঘেঁষে যে রাস্তা চলে গিয়েছে, বোধ হয় তার ডান হাতের চার নম্বর বাড়ি। দোতলা। আমার তখন উত্তেজনা ও ভয় মিশ্রিত অস্থির মন। কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন শ্যামলদা— “এসো শুভ, তোমাদের দিদিভাইকে ডাকছি।” শ্যামলদা, বাংলা গানের প্রখ্যাত গীতিকার শ্যামল গুপ্ত, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের স্বামী । কিছুক্ষণ পরে ঘরে এলেন বা়ংলা গানের দেবী সরস্বতী । তখন গোধূলি।‌ জানালা দিয়ে আলগোছে পড়ন্ত সূর্যের শেষ রশ্মি শাড়ির আঁচল ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমি প্রণাম করতেই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন ‘বসো ভাই’।‌ আমি তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে। এত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম যে রেকর্ডিং নিয়ে কোনও আলোচনা শুরুই করতে পারছিলাম না। ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগল। তার পরে আলোচনা শুরু, বেশির ভাগটাই শ্যামলদার সঙ্গে। ঠিক হল, আটটি গান হবে। শ্যামলদার লেখা ছ’টি গান রেকর্ড হবে এবং তাতে দুটো করে গানে সুর করবেন জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় , মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং স্বপন বসু। আর বাকি দুটি গান লিখবেন এবং সুর করবেন কবীর সুমন। আনন্দে-উত্তেজনায় পূর্ণ হয়ে বাড়ি ফিরলাম।

Advertisement

রেকর্ডিং শুরুর সাত দিন আগে ফের সন্ধ্যাদির বাড়িতে। শ্যামলদা বললেন, “তুমি এই প্রথম তোমাদের দিদিভাইয়ের রেকর্ডিং করছ। তাই তোমার একটি বিষয় জানা নেই । আচ্ছা, তুমি দোতলায় দিদিভাইয়ের ঘরে যাও। তোমাকে খুব স্নেহ করেন।” দোতলায় উঠে দেখলাম, ঘরের দরজা ভেজানো। আলতো করে দরজা ঠেলে ঢুকেই আমি স্থির। হারমোনিয়ামের উপরে অনেক ছোট ছোট কাগজ রাখা।‌ একান্ত প্রয়োজনে ওই কাগজে নিজের প্রয়োজনটুকু লিখে রাখার জন্য। সন্ধ্যাদি মৌনব্রত পালন করছেন! অহেতুক কথা বললে গলায় বাড়তি ধকল আর মনোস়ংযোগ নষ্ট হবে। তাই তিনি তখন একাগ্র চিত্তে ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন, যাতে রেকর্ডিংয়ে সংগীতের অঞ্জলিতে কোনও খামতি না থাকে। আমি তখন বাকরুদ্ধ, আবেগতাড়িত । এমন অভিজ্ঞতা যে এই প্রথম। আমার কাছে আজও যা এক বিস্ময়!

অবাক হওয়ার আরও খানিক তখনও বাকি। প্রথম দিনের রেকর্ডিং। সকাল সাড়ে ন’টায় কলটাইম এইচএমভি-র দমদম স্টুডিয়োয়। আমি, সহকর্মী দিলীপদা, রেকর্ডিস্ট সোমনাথ মণ্ডল, আমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ— সকাল ন’টাতেই সকলে উপস্থিত। যে সমস্ত মিউজিশিয়ানের দেরি করে স্টুডিয়োতে আসা অভ্যাস, তাঁরাও সে দিন ঠিক সময়ে হাজির। কাঁটায় কাঁটায় পৌনে ন’টার সময়ে অ্যাম্বাস্যাডর গাড়ি দমদম ফ্যাক্টরিতে ঢুকে স্টুডিয়োর সামনে দাঁড়াল। সন্ধ্যাদি গাড়ি থেকে নামলেন। ডান হাতে অনেকগুলো ছোট ছোট বেল ফুলের মালা আর বাঁ হাতে ততোধিক ছোট ছোট ক্যাডবেরি। যাঁরা যাঁরা তখন উপস্থিত, সকলকে একটা করে মালা আর একটা করে ক্যাডবেরি দিয়ে ফ্লোরে ঢুকলেন! আমি ভাবছি এ-ও সম্ভব ? অপরকে কতটা ভালবাসলে , সম্মান করলে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় হওয়া যায়!

সেই রেকর্ডিংয়ে এইচএমভি-র ফ্লোরে বাংলার সব দিকপাল মিউজিশিয়ানরা। যন্ত্রসংগীত পরিচালনায় দূর্বাদল চট্টোপাধ্যায়, তবলায় প্রীতিময়দা, জয় (নন্দী), বেহালায় ভায়োলিন ব্রাদার্স, অ্যাকর্ডিয়ানে বেবীদা (প্রতাপ রায়), সেতারে রাহুল চট্টোপাধ্যায়, পারকাশনে সঞ্জীবন আচার্য , কি-বোর্ডে গৌতম সোম আর সঙ্গীত পরিচালক সুমনদা (কবীর সুমন)। সন্ধ্যাদি গানের প্রথম লাইন ‘চল দেখি কত দূরে যাবে’ গাইলেন। সুমনদা কৃতজ্ঞতায় কনসোল রুমের মাটিতে নতজানু হয়ে স্মরণ করলেন আল্লাহকে। প্রণাম জানালেন সন্ধ্যাদিকেও। আর আমরা সাক্ষী থাকলাম এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের। এক টেকে গান ওকে। তার পর সে দিনের মতো প্যাকআপ। এ ভাবেই প্রতি দিন একটা করে গান এক টেকে রেকর্ড করে গেলেন সন্ধ্যাদি। শেষ হল জটিলদা, মৃণালদা, স্বপনদা আর সুমনদার সুর দেওয়া গান। গান শুরু করার সন্ধ্যাদি আগে মাইক্রোফোনে বলতেন “স্বপন / সুমন ভাই, ভুল করলে থামিয়ে দেবেন।” ভুল ? যার কন্ঠে স্বয়ং দেবী সরস্বতীর বাস, রাগসঙ্গীতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাঁর অবাধ বিচরণ , রিহার্সাল যাঁর এমন নিখুঁত, তাঁর হবে ভুল? কিন্তু অপরকে সম্মান করার আর এক নাম যে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়! তাই স্বপনদা , সুমনদাকে এ ভাবে বলা। অনুভব করলাম— যিনি যত বড়, তিনি ততটাই বিনয়ী। দম্ভ যাকে স্পর্শ করতে ভয় পায়।

২০০৩ সালে রেকর্ডিং অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল মাধ্যমে অভ্যস্ত। ট্র্যাক রেকর্ড হওয়ার পরে শিল্পী এসে তাঁর মতো করে ডাবিং করে থাকেন। রেকর্ডিং হয়তো নিখুঁত হয়। কিন্তু মিউজিশিয়ান, শিল্পী ও শিল্পের মধ্যে যে ভাবের আদান-প্রদান, সেটাই বাদ চলে যায়। মাঝেসাঝে প্রশ্ন জাগতেই পারে, গানের মধ্যে প্রাণ আছে তো? সেই দুর্ভাবনাকে তেপান্তরের পারে ছুড়ে ফেলে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল সন্ধ্যা দির রেকর্ডিং এ। মিউজিশিয়ান ও শিল্পীর মধ্যে যে জীবন্ত তালমিল, তা সে দিন নিজে উপস্থিত থেকে অনুভব করেছিলাম। একই অনুভূতি হয়েছিল মান্নাদার রেকর্ডিংয়েও। শেষমেশ ষষ্ঠীর দিন এইচএমভি থেকে প্রকাশিত হল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের শেষ অ্যালবাম ‘অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটছে’।

সন্ধ্যাদি কত বড় গায়িকা ছিলেন, সে আলোচনা করবেন সঙ্গীতের বোদ্ধারা এবং আগামী। কিন্ত ডি- ৬১৩ বাড়ির অন্তঃপূরবাসিনী, যিনি শেষ দিন পর্যন্ত অনতিক্রম্য দূরত্বে থাকতে ভালবেসেছেন, তার গান বাঙালি হৃদয়কে আজীবন আপ্লু্ত করবে, আলোড়িত করবে , অভিভূত করবে। তাই প্রতি দিন সূর্যের প্রথম আলো দেখে বাঙালি মন গেয়ে উঠবে ‘কী মিষ্টি, দেখো মিষ্টি, কী মিষ্টি এ সকাল…’। আর গানের আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে থেকে যাবেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
লেখক এইচএমভি-র প্রাক্তন কর্তা

আরও পড়ুন
Advertisement