পঞ্চাশ বছর পার! তবু যুদ্ধ থামেনি... গ্রাফিক্স- শৌভিক দেবনাথ
দুর্বলের উপর সবলের ছড়ি ঘোরানোর পালা শেষ হয়নি। যুদ্ধ থামেনি। তাই পঞ্চাশ বছর পরেও জ্বলছে প্রতিবাদের আগুন। আরও প্রকট হয়ে মঞ্চে আসতে চলেছে ‘মারীচ সংবাদ’। যে নাটক সম্বল করে একদা পথ চলা শুরু হয়েছিল অরুণ মুখোপাধ্যায়ের নাট্যদল ‘চেতনা’-র। ১৯৭২ সালের অগস্টে মহাকরণের ক্যান্টিন হলে প্রথম শো। বহু দেশি-বিদেশি ভাষায় অনূদিত নাটকটি এ বার অর্ধশতক অতিক্রম করল।
সেই সঙ্গে ‘চেতনা’-রও অর্ধশতবর্ষ পূর্তি। বৃহস্পতিবার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে নতুন করে ‘মারীচ সংবাদ’ দিলেন নীল ওরফে সুজন মুখোপাধ্যায়। জানালেন, এ বার আর দলের ছেলেমেয়েরা নয়। পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে সকলের প্রিয় তারকাদের নিয়ে বিশেষ সম্মিলিত অভিনয়ে মঞ্চস্থ হবে তাঁদের বৈগ্রহিক নাটক। ১৯ নভেম্বর সকাল ১১টা, দুপুর ৩টে এবং সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা মিলিয়ে মধুসূদন মঞ্চে একই দিনে তিনটি শো ‘মারীচ সংবাদ’-এর।
তবে নীলের কথায়, “তারকা মানে তাঁরা সিনেমা-সিরিয়াল করেন বলে নয়, তাঁদের সবার শিকড় এই থিয়েটারে। অনির্বাণ চক্রবর্তী, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, দেবশঙ্কর হালদার, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, সুমন মুখোপাধ্যায়, সুরজিৎ বন্দোপাধ্যায় কিংবা আরও যাঁরা এই প্রযোজনায় থাকবেন, তাঁরা সকলেই আসলে পেশাদার নাট্যব্যক্তিত্ব। এখন পর্দায় কাজ করলেও শুরুটা হয়েছিল থিয়েটারেই। তাই তাঁদের একসঙ্গে এনে মারীচ সংবাদের পঞ্চাশকে স্মরণীয় করে রাখতে চাওয়া।”
এক দিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পটভূমি। আমেরিকার সাংবাদিক গ্রেগরির উপর সেনেটর ম্যাকির জোরজুলুম, তাঁকে যেতেই হবে ভিয়েতনামে। অন্য দিকে রামায়ণ। রাবণের আদেশে মায়ামৃগ সেজে যুদ্ধ ডেকে আনা মারীচের প্রতিবাদ। রাবণের বেতনভুক কর্মচারী নাকি সে? আবার আর একটু এগিয়ে বাংলার মাটিতে প্রজাদের উপর অত্যাচার করতে জমিদারের খাস লেঠেলের তীব্র আপত্তি। ইতিহাসের বিভিন্ন যুদ্ধ-পরিস্থিতিকে সেলাই করে তৈরি হয়েছিল ‘মারীচ সংবাদ’।
যার প্রাসঙ্গিকতা ফুরোলেই খুশি হন স্রষ্টা অরুণ। বললেন, “মারীচ সংবাদ চলছে তো চলছেই। ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেমে গিয়েছে। তবু নাটকের প্রয়োজনীয়তা ফুরোয়নি। যুদ্ধ তো লেগেই আছে। অন্যায় চলছে। এ সব যত দিন চলবে তত দিনই আয়ু ‘মারীচ সংবাদ’- এর। তার পর বন্ধ হয়ে গেলে খুব খুশি হব।” যদিও তাঁর খুশি হওয়ার রাস্তা ক্রমশ দুরাশায় ম্রিয়মাণ। তবু ‘চেতনা’র পঞ্চাশে পদার্পণের উৎসবে আবার জমকালো করে ‘মারীচ সংবাদ’-এর পালা পড়বে। ফের বেজে উঠবে ওস্তাদের ডুগডুগি, শুরু হবে জাদুকাঠির খেলা। সেই আনন্দে বুঁদ হয়ে আছেন অরুণ।
তাঁর বড় ছেলে সুমন ওরফে লাল চেতনা থেকে নিজের পথ আলাদা করে অন্য দল গড়েছেন। তবু এখনও তাঁর বড় হওয়ায় জড়িয়ে ‘চেতনা’। সগর্বে বললেন, “আমার রক্তে ‘চেতনা’। উৎকর্ষ নিয়ে এত বছর চলা কম কথা নয়। আমাদের যে প্রযোজনার ধরন, বীক্ষা— যদি কেউ মন দিয়ে দেখেন, বুঝবেন সেগুলো সামাজিক-রাজনৈতিক বোধে ভরপুর। দেশে-বিদেশে আন্তর্জাতিক থিয়েটার দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বুক চাপড়ে বলতে পারি, ‘মারীচ সংবাদ’ উচ্চমার্গের নাটক। বিশ্বের যে কোনও ভাল নাটকের সঙ্গে এক তালিকায় স্থান করে নিতে পারে এটি। শুধু তা-ই নয়, আমি বলব ব্রেখটের নাট্যরীতির কিঞ্চিৎ প্রভাব থাকলেও ‘মারীচ সংবাদ’ দেশের শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত। নাগরিক জীবনের সঙ্গে যেখানে জড়িয়ে রয়েছে গ্রামীণ জীবন।”
এ বারের জমকালো ‘মারীচ সংবাদ’-এ মারীচ হবেন অনির্বাণ চক্রবর্তী। শুধু এ বার বলে নয়, গত ৭ বছর ধরে তিনিই ‘চেতনা’র মারীচ। তবে অনুভূতিটা একটু আলাদা। বললেন, ‘‘আমি, সুমন আর কৌশিক ছাড়া এ বারের প্রযোজনায় সব শিল্পী নতুন। খুব আনন্দ হচ্ছে। একসঙ্গে এত জন বিদগ্ধ অভিনেতাকে এক মঞ্চে এর আগে হয়তো দেখাও যায়নি। সবাই মিলে রিহার্সাল করব, তার পর এক দিনে তিনটে শো! এ সত্যিই আমার সৌভাগ্য।’’ বর্তমানে জটায়ু এবং একেনবাবু চরিত্রে পর্দায় জনপ্রিয় অভিনেতা অনির্বাণ। তবু থিয়েটার তাঁর প্রাণ। জানালেন, পুরাণের মারীচ রাক্ষসের চরিত্র এ কালের শোষিতের দ্যোতক। রাবণ তার মাকে বাঁচিয়েছিল বলে সে কোথাও দায়বদ্ধ। যখন কালনেমি এসে বলে, সোনার হরিণ সেজে রামকে বধ করতে যেতে হবে, শুরুতে রাজি হয় না মারীচ। মনে মনে সে তো রামেরই পূজারী। প্রতিবাদ উঠে আসে সেখান থেকেই। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেন কাউকে কাজ করানো হবে? শুধু কি ক্ষমতার জোরে? মারীচ হয়ে প্রশ্ন তুলছেন অভিনেতা। ফিরে আসবেন নিজের কাছেও, বলে উঠবেন ‘‘এই জায়গাটা ঠিক হচ্ছে না।’’ এমন ভাবেই সজাগ করতে করতে এগোয় জোর করে ভিয়েতনাম যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেওয়া আমেরিকার সাংবাদিক গ্রেগরিও। যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। একই ভাবে নির্যাতিত হতে হতে প্রশ্ন তোলে জমিদারের খাস লেঠেল। অভিনয়ে অধিকারী কৌশিক।
আসলে ‘মারীচ সংবাদ’ রাজনৈতিক ইতিহাসের পথ। যে পথে এক হতে চলেছেন কলকাতা নাটকের মহারথীরা। আগামী ১৮ নভেম্বর থেকে ২৩ নভেম্বর, ছয় দিন ধরে নাট্যোৎসবের আয়োজন করেছে ‘চেতনা’। সেখানে প্রথম দিন রয়েছে ব্রাত্য বসুর নাটক ‘রানি ক্রেউসা’। পরিচালনায় সুজন মুখোপাধ্যায়। দ্বিতীয় দিনে অরুণ মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় ‘মারীচ সংবাদ’-এর তারাখচিত তিন শো। ২০ নভেম্বর চেতনার অন্যতম জনপ্রিয় প্রযোজনা ‘জগন্নাথ’। নির্দেশনায় অরুণ। উৎসবের শেষ দিন, অর্থাৎ ২৩ নভেম্বর থাকছে সুমন মুখোপাধ্যায়ের ‘মেফিস্টো’।
দলের অধুনা পরিচালক সুজন জানান, উৎসব উপলক্ষে নতুন ‘মারীচ সংবাদ’-এর রিহার্সাল শুরু হবে আগামী ১০ নভেম্বর থেকে।