শাস্ত্রীয়সঙ্গীত, লঘু শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, আধুনিক গান, নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং সেই সঙ্গে মুম্বইয়ে হিন্দি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক— এত দীর্ঘ সময় ধরে বাংলার কোনও শিল্পীর সঞ্চারপথ এত ব্যাপক নয়। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
বাংলা অভিনয়ের জগৎ যেমন সাবালক হয়েছিল উত্তম-সুচিত্রা জুটির হাত ধরে, তেমনই বাংলা গান, বিশেষ করে বাংলা আধুনিক এবং ফিল্মের গান সাবালকত্ব লাভ করেছিল হেমন্ত-সন্ধ্যা বা মান্না-সন্ধ্যা জুটির সৌজন্যে। পুরুষকণ্ঠের গানকে আধুনিক রূপ দিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা মান্না দে যে কাজটি করেছেন, নারী কণ্ঠে সেই কাজের সূচনা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে। যে কারণে এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, বাংলা সঙ্গীতে মহিলা কণ্ঠের আধুনিকতার মূর্ত প্রতীক সন্ধ্যা। এত দিন যিনি ছিলেন সেই ইতিহাসের জীবন্ত দলিল হয়ে। দীর্ঘ দিনই জনসমক্ষে গান করতেন না। তথাপি ছিলেন সঙ্গীত জগতের যুগ পরিবর্তনের এক সত্যদ্রষ্টা শিল্পী হিসাবে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণ সুতরাং আক্ষরিক অর্থেই যুগাবসান।
একই সঙ্গে শাস্ত্রীয়সঙ্গীত, লঘু শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, আধুনিক গান, নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং সেই সঙ্গে মুম্বইয়ে হিন্দি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক— এত দীর্ঘ সময় ধরে বাংলার কোনও শিল্পীর সঞ্চারপথ এত ব্যাপক নয়। এ কথা সকলেরই জানা যে, প্রত্যেক সঙ্গীতের গায়নশৈলী ভিন্ন। সন্ধ্যার বড় কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে প্রত্যেকটি শৈলীর গান আপন ভাব অক্ষুণ্ণ রেখে নিবেদন করা। যে কারণে ‘এ শুধু গানের দিন’, ‘আমি যে জলসাঘরে’-র মতো ফিল্মের গান কিংবা ‘দিবস রজনী, আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি’-র মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁর কণ্ঠে সমান জনপ্রিয় হয়েছে। প্রকৃতার্থেই তিনিই তো ‘গীতশ্রী’! সম্প্রতি কেন্দ্র তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। ‘গীতশ্রী’ তা প্রত্যাখ্যান করেন।
১২ বছর বয়সে কলকাতা আকাশবাণীর ‘গল্পদাদুর আসর’-এ প্রথম গেয়েছিলেন গীতিকার অজয় ভট্টাচার্যের লেখা একটি গান। রেডিয়োয় প্রথম পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন পাঁচ টাকা। ১৩ বছর ১০ মাস বয়সে প্রথম বেসিক রেকর্ড। এইচএমভি থেকে প্রকাশিত। গানের কথা ও সুর গিরিন চক্রবর্তীর। এক দিকে ‘তুমি ফিরায়ে দিয়ে যারে’, উল্টো পিঠে ‘তোমারো আকাশে ঝিলমিল করে চাঁদের আলো।’
বছর দু’য়েকের মধ্যে দু’টি বাংলা ছবিতে নেপথ্যে গাওয়ার সুযোগ। প্রথম ছবির সঙ্গীত পরিচালক কিংবদন্তি রাইচাঁদ বড়াল। ছবির নাম ‘অঞ্জনগড়’। দ্বিতীয় ছবি ‘সমাপিকা’-র সঙ্গীত পরিচালক রবীন চট্টোপাধ্যায়। সে বছর, অর্থাৎ চল্লিশের দশকের শেষের দিকে তিনটি আধুনিক গানের রেকর্ড! চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যার সাঙ্গীতিক উপস্থিতিই বলে দেয় যে তাঁর সফরটি দীর্ঘ হতে চলেছে।
সন্ধ্যার জন্ম ৪ অক্টোবর ১৯৩১ সালে। দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায়। নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং হেমপ্রভা দেবীর কন্যা ছিলেন ছয় সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ। সন্ধ্যা নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁদের বংশের আদি পুরুষ রামগতি মুখোপাধ্যায় বড় সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তাঁর পুত্র সারদাপ্রসাদও গান-বাজনার চর্চা করতেন। সারদাপ্রসাদের ছেলে সন্ধ্যার ঠাকুরদা। এঁরা প্রত্যেকেই উচ্চাঙ্গসঙ্গীত নিয়ে চর্চা করতেন। সন্ধ্যার বাবা নরেন্দ্রনাথ ছিলেন কৃষ্ণভক্ত। বাবার কাছেই প্রথম গান শেখা। সন্ধ্যাকে ভক্তিমূলক গান শেখাতেন তিনি। সন্ধ্যার মা-ও গান গাইতেন। নিধুবাবুর টপ্পা ছিল প্রিয়। মায়ের গানে মুগ্ধ হতেন সন্ধ্যা। ভাবতেন, না শিখে একজনের গলায় এত সূক্ষ্ম কাজ আসে কী করে!
১৯৪৩ সালের ৫ ডিসেম্বর। মাত্র ১২ বছর বয়সে অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স আয়োজিত সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় ভজন বিভাগে প্রথম হয়েছিলেন সন্ধ্যা। সেই প্রতিযোগিতায় মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়ও অংশ নেন।
সাড়ে ১৪ বছর বয়সে ‘গীতশ্রী’ পরীক্ষাতেও প্রথম। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি পরীক্ষাটি হয়েছিল। ‘ভজন’ ও ‘গীতশ্রী’ দু’টি পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার পর বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় গান গাওয়া শুরু হয় এবং তার পর থেকে তা চলতেই থাকে। একাধারে খেয়াল, ঠুংরি, ভজন, গজল, কীর্তন, ভাটিয়ালি, বাউল, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, পুরাতনী— বাংলা গানের এমন কোনও ধারা নেই, যেখানে তাঁর পদসঞ্চার লক্ষ করা যায়নি। এর পাশেই চলতে থাকে তালিম।
১৯৮৯ সালের ১৩ অক্টোবর প্রয়াত হন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতের বিশিষ্ট শিল্পী ও শিক্ষক উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের পুত্র উস্তাদ মুনাওয়ার আলি খান।১৯৮৯-এর ২ ডিসেম্বর প্রকাশিত ‘দেশ’ পত্রিকায় সন্ধ্যার একটি স্মৃতিচারণ প্রকাশিত হয়েছিল। নিজের সঙ্গীত শিক্ষা সম্পর্কে সন্ধ্যা সেখানে লিখেছিলেন,‘১৯৫০-৫১ সাল হবে। শ্রদ্ধেয় জ্ঞানদার (জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ) বাড়িতে বাবার কাছে মানে ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি যাঁর কাছে গান্ডা বাঁধি। আমার সংগীতে হাতেখড়ি অবশ্য শ্রদ্ধেয় যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। পরে বিভিন্ন সময় সঙ্গে শ্রদ্ধেয় চিন্ময় লাহিড়ী, এ কানন, ডিটি যোগী, গণপত রাও, জ্ঞানদা ও সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে - কিছু সুযোগ সুবিধেমত শিক্ষাগ্রহণের সৌভাগ্য হয়েছে। তা ওই পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকেই বাবার সঙ্গে যোগাযোগ। তখন বাবা সারা ভারতে গেয়ে বেড়াচ্ছেন। কোন স্থায়ী ঠিকানা থাকাও নেই। আজ এখানে, কাল ওখানে কনফারেন্স। বাবা কলকাতায় কখনও জ্ঞানদার ডিকসন লেনের বাড়িতে, কখনও ঝাউতলায় মিঃ কাদেরের বাড়িতে, জাস্টিস মিঃ মাসুদের বাড়িতে থাকতেন। পরে তাঁদের স্থায়ী ঠিকানা হয় বালু হক্কক লেনে। সেখানে শিখতে যেতুম। সেখানেই ভাইয়ার সঙ্গে পরিচয়। আমি, মীরা (মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়) শিখতুম, মাঝে মাঝে ভাইয়া (মুনাওয়ার আলি) ও এসে আমাদের সঙ্গে তালিম নিতেন।’
বড়ে গোলাম আলির প্রয়াণের পর মুনাওয়ার আলির কাছেও গান শেখেন সন্ধ্যা। মুনাওয়ার সন্ধ্যাকে ডাকতেন সন্ধ্যাদি বলে। কেমন ছিল সেই শিক্ষা? একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাক। একবার তিনি বড়ে গোলামের কয়েকটি বিখ্যাত হিন্দি ঠুংরির অনুসরণে বাংলা ঠুংরি (যেমন—‘আসে না শ্রীতম’, ‘বাজুবন্ধ খুলে খুলে যায়’, ‘কাটে না বিরহেরি রাত’ ইত্যাদি) রেকর্ড করেন মুনাওয়ারের তত্ত্বাবধানে। তখন তিনি সন্ধ্যাকে বলেছিলেন, ‘‘দেখো সন্ধ্যাদি, যেমন ভাবে বাবা অলংকরণগুলি করেছেন, সে ভাবে আমাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। আর চেষ্টা করাটা বাঞ্ছনীয়ও নয়— বাবানে যো কিয়া ও জনম জনম করনে সে হামলোগোকো নেই আয়েগা।’’
অতঃপর, তিনি একটু অন্যরকম করে অলংকরণগুলি করে দেখালেন এবং সন্ধ্যাকে সে ভাবেই করতে বলেন। সন্ধ্যা লিখছেন, ‘শিক্ষক হিসেবেও ভাইয়া ছিলেন আদর্শস্থানীয়। উচ্চাঙ্গ সংগীতে ওনার জ্ঞান ছিল অপরিসীম। বাবা জন্মেছিলেন গানেরই জন্য। আর ভাইয়া গান করা ছাড়াও যেভাবে গান শিখিয়েছেন তা অনবদ্য। তাঁর শিক্ষাদানের পদ্ধতিটি চমৎকার। কে কতটুকু গ্রহণ করতে পারে, কার কণ্ঠ কিরকম, কার সীমা কতটুকু সেসব বুঝেই শিক্ষা দিতেন ভাইয়া। শিক্ষাদানে কোন ফাঁকি ছিল না।’
সন্ধ্যার শিক্ষার দিকে তাকালে বলতে হয় তিনি মূলত পটিয়ালা ঘরানায় দীক্ষিত ছিলেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এমন তন্নিষ্ঠ তালিম থাকলেও আধুনিক, ছায়াছবি কিংবা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার সময় তাঁর শাস্ত্রীয়সঙ্গীত শিল্পীর সত্তাটি সযত্নে লুকিয়ে রাখতে পারতেন। যে গানের যে শৈলী, সেই গানে সেই শৈলীতেই প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতেন।
চল্লিশের দশকের শেষ। রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ‘বিদুষী ভার্যা’ ছবির গান রেকর্ডিং সেরে সবে বাড়ি ফিরেছেন সন্ধ্যা। শচীন দেববর্মনের পরিচিত এক ব্যক্তি শচীন গঙ্গোপাধ্যায় সন্ধ্যার বাড়িতে এসে বললেন, ‘‘শচীনকত্তা তোমাকে বম্বে নিয়ে যেতে চান। শচীনদার স্ত্রী মীরা দেববর্মনও তোমার গান শুনতে চেয়েছেন।’’ শচীনদেব আগে মুম্বই চলে গিয়েছেন। কলকাতায় সাউথ এন্ড পার্কের বাড়িতে মীরাদেবী তখনও থাকতেন। এর পর এক দিন সন্ধ্যা গান শুনিয়ে এলেন মীরাদেবীকে। শুনে ভাল লেগেছিল তাঁর। অতঃপর, পর ১৯৫০-এ মুম্বই যাত্রা।
মুম্বইয়ে খার স্টেশনের পাশে ‘এভারগ্রিন’ হোটেলে শচীনদেবের আস্তানা ছিল। সন্ধ্যাদের ব্যবস্থাও সেখানেই করেছিলেন। শচীনদেবকে আগে থেকে চিনতেন সন্ধ্যা। কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে আলাপ হয়েছিল।
শচীনদেব নিয়ে গেলেও মুম্বইয়ে প্রথম প্লেব্যাকের সুযোগ হল অনিল বিশ্বাসের সুরে। ‘তারানা’ ছবিতে। শোনা যায়, সন্ধ্যার বড়দা মুম্বইয়ে অনিল বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। অনিলের বাড়িতে সন্ধ্যারা মাঝে মাঝে যেতেন, গানবাজনা হত। অনিলের সুরে ‘তারানা’ ছবিতে গাইতে গিয়েই লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে পরিচয় হয়। গানটা ছিল লতার সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে— ‘বোল পাপিহে বোল রে, তু বোল পাপিহে বোল’। অভিনেত্রী মধুবালার লিপে লতার কণ্ঠ। সন্ধ্যার গান ছিল শ্যামার লিপে। অনিলের সুরে পরে ‘ফরেব’ ছবিতেও গেয়েছেন সন্ধ্যা। পরিচয়ের কিছু দিনের মধ্যেই লতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়ে যায় সন্ধ্যার। লতা প্রায়ই আসতেন এভারগ্রিন হোটেলে সন্ধ্যার কাছে। সাধারণ বেশভূষা, আন্তরিক ব্যবহার। লতাকে ভাল লেগেছিল সন্ধ্যার। লতার সঙ্গে গান নিয়ে নানা আলোচনা হত। পরবর্তী কালে সন্ধ্যার ঢাকুরিয়ার বাড়িতেও এসেছেন লতা।
মোটের উপর ১৭টি হিন্দি চলচ্চিত্রে নেপথ্য গায়িকা হিসেবে গান করেছেন সন্ধ্যা। তবে যে কোনও কারণেই হোক বলিউডে নিজের সাঙ্গীতিক জীবন দীর্ঘায়িত করেননি। ব্যক্তিগত কারণে ১৯৫২ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৬ সালে কবি, গীতিকার শ্যামল গুপ্তের সঙ্গে বিবাহ। তাঁর বহু গানের গীতিকার শ্যামল। শ্যামলের সঙ্গে বিবাহের পর তাঁর জীবন খানিক বদলে যায়। বাইরের জগতের অনেক কিছু যাতে সন্ধ্যাকে স্পর্শ না করে, যাতে তিনি নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকতে পারেন, সে চেষ্টা সর্বদা করে গিয়েছেন শ্যামল। এই সময়কাল সন্ধ্যার জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একের পর এক আধুনিক গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে। সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ, রবীন চট্টোপাধ্যায় কিংবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো সুরকারের সুরে একাধিক গান রেকর্ড করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে চুটিয়ে ফিল্মে নেপথ্যে গান।
সন্ধ্যার শিল্পী জীবনের অন্যতম মাইলফলক ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’-তে অংশগ্রহণ। পঙ্কজকুমার মল্লিক, বাণীকুমার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আর একঝাঁক শিল্পীর সঙ্গে সন্ধ্যাও ছিলেন। সে সময় ‘লাইভ’ অনুষ্ঠান হত। রাত ৩টের মধ্যেই চলে যেতে হত ১ নং গার্স্টিন প্লেসে। গঙ্গাস্নান করে গরদের ধুতি-চাদর গায়ে ভাষ্য পাঠ করতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। ‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে জাগিল ধ্বনি’ গানটি এখনও সন্ধ্যার গলায় শোনা যায়। এই গানটি অবশ্য পরবর্তী কালে রেকর্ড করা। লাইভে তিনি কখনও গাননি এ গান। কৃষ্ণা দাশগুপ্তের রেকর্ড করা গান ‘অখিল বিমানে তব জয়গানে’ এবং প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অমল কিরণে ত্রিভুবন মনোহারিণী’ লাইভে সন্ধ্যা গেয়েছেন বহু বার। আসলে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’-র অনুষ্ঠান যখন লাইভ হত, তখন বিভিন্ন শিল্পী প্রতি বছর একই গান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইতেন।
‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে সুচিত্রার লিপে প্রথম সন্ধ্যার কণ্ঠ শোনা যায়। প্রথম থেকেই সুচিত্রা-সন্ধ্যা জুটি সুপারহিট! সুচিত্রা এমন ভাবে লিপ দিয়েছিলেন, যে দর্শকদের মনে হয়েছিল যেন তিনি নিজেই গাইছেন। সন্ধ্যার উচ্চারণ, অভিব্যক্তি, কণ্ঠের মড্যুলেশন— সব মিলিয়ে বাংলা ছবির গানের উপস্থাপন ভিন্ন মাত্রা পেতে থাকল এই সময় থেকে। পূর্বসূরীর মধ্যে অন্যতম কাননদেবীর গায়নশৈলীর থেকে ধীরে ধীরে যা পৃথক হতে থাকে। পুরুষদের ক্ষেত্রে যে কাজটি করেছিলেন হেমন্ত এবং পরবর্তী কালে মান্না, নারী কণ্ঠে তা করলেন সন্ধ্যা। হেমন্তের পূর্বসূরিদের অন্যতম কেএল সায়গল বা পঙ্কজকুমার মল্লিকের গানের স্টাইলের থেকে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকের প্রচলন করেছিলেন বাংলা গানে। ছবিতে উত্তম কুমারের লিপে গান মানেই যেমন দর্শকদের কাছে ছিল হেমন্তের কণ্ঠ, তেমন সুচিত্রা মানেই যেন সন্ধ্যা। বিভিন্ন ধারার গানে সন্ধ্যার অনায়াস বিচরণ যেমন তাঁর গান-জীবনের একটি দিক, তেমনই অন্য দিকে থাকে সুচিত্রার লিপে তাঁর কণ্ঠদান। এটি যেন তাঁর সঙ্গীত জীবনের স্বতন্ত্র একটি অঙ্গ, যা জনপরিসরে তাঁকে দিয়েছিল ভিন্ন একটি আসন, হেমন্ত-মান্না বাদে সমসাময়িক বাংলার কোনও শিল্পীর যা ছিল না।
জাতীয় পুরস্কার-সহ বহু সম্মাননা পেয়েছেন সন্ধ্যা। তবে তাঁর সব চেয়ে বড় পুরস্কার হয়তো মানুষের হৃদয়ে তাঁর স্থান। বহু দিনই জনপরিসরে গান করতেন না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুরোধে কয়েক বছর আগে এক অনুষ্ঠানে এসে হাতে মাইক তুলে নিয়ে দু’কলি গেয়েছিলেন। সুরেলা কণ্ঠের ঝলকে উপস্থিত শ্রোতারা লহমায় ফিরে যান অতীতে। সুরের ঐশ্বর্য সঙ্গে নিয়েই বিদায় নিলেন সন্ধ্যা।