কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রাণকেন্দ্র নন্দন। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
হাতে আর মাত্র চার দিন। শুরু হচ্ছে ৩০তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। কিন্তু আসন্ন উৎসবকে ঘিরে টলিপাড়ায় ‘বিতর্ক’ শুরু হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, ইন্ডাস্ট্রির একটা বড় অংশ উৎসবকে ‘বয়কট’ করেছে। গত এক দশকে সময়ের সঙ্গে উৎসব কলেবরে এবং চাকচিক্যে বড় হয়েছে। কিন্তু অভিনেতা এবং পরিচালকদের একটা বড় অংশ যদি উৎসব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তা হলে উৎসবের সার্বিক গুণগত মানে প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই। কিন্তু কেন এই ‘বয়কট’?
দিন কয়েক আগেও নন্দন চত্বরে উৎসবের প্রস্তুতি সেই ভাবে গতি পায়নি। এমনকি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রও নাকি ছাপা হয়েছে দেরিতে এবং শোনা যাচ্ছে টলিপাড়ার নির্দিষ্ট বৃত্তেই তা পাঠানো হবে। ফলে ইন্ডাস্ট্রির অন্দরে নানা প্রশ্ন উঠছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ইন্ডাস্ট্রির এক পরিচালকের কথায়, ‘‘যা খবর পেয়েছি, এই বছর উৎসবে টলিউডের প্রায় কেউই থাকবে না।’’ এর নেপথ্যে কি রয়েছে আরজি কর-কাণ্ডে শাসকদলের সঙ্গে টলিপাড়ার বিরোধ? ওই পরিচালক উত্তর দিতে রাজি হননি। ইন্ডাস্ট্রির অন্য এক সদস্যের কথায়, ‘‘টলিপাড়ার একটা বড় অংশই তো সরে এসেছে। এটা এখন শুধুই সরকারি উৎসব। তাঁরা যা ভাল বুঝছেন, সেই ভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে।’’
চলতি বছরে তিন দশক পূর্ণ হচ্ছে চলচ্চিত্র উৎসবের। তাই উৎসবের জাঁকজমক আরও বাড়বে, সে রকমই মনে করছিল সিনেপ্রেমীদের একাংশ। কিন্তু আদৌ তা হবে কি না, তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। কারণ গত কয়েক মাসে শাসকদলের সঙ্গে বার বার টলিপাড়ার সংঘাত বেধেছে। পরিচালক রাহুল মুখোপাধ্যায়ের ছবি ঘিরে টলিপাড়ার ফেডারেশন বনাম পরিচালকদের বিরোধ মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছেছে। তার পর আরজি কর-কাণ্ডে টলিপাড়ার একটা বড় অংশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হয়। সূত্রের দাবি, এই বিরোধিতা শাসকদলের সঙ্গে টলিপাড়ার ‘দূরত্ব’ বাড়িয়েছে, যার প্রভাব পড়তে পারে আসন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে।
গত কয়েক বছর উৎসবের চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব পালন করেন পরিচালক রাজ চক্রবর্তী। এ বারে তাঁর পরিবর্তে নেতৃত্ব দেবেন পরিচালক গৌতম ঘোষ। উৎসবের পরিচালন সমিতির এক সদস্যের কথায়, ‘‘এখানে অনেক রকমের জটিলতা এবং পক্ষপাত রয়েছে। ইন্ডাস্ট্রির শিল্পীদের উপরে উৎসবের ছোট-বড় নানা দায়িত্ব দেওয়া হয়, কারণ তাঁরা অভিনেতা এবং সিনেমা বিষয়টা ভাল বোঝেন। এ বার অভিনেতারাই না থাকলে কী হতে পারে, তা বোঝাই যাচ্ছে। মোদ্দা কথা, শিক্ষিত মানুষদের তো দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে উৎসবেও তার প্রভাব দেখা যাবে।’’ গত বছর উৎসবে এসেছিলেন মনোজ বাজপেয়ী, সৌরভ শুক্লের মতো বলিউড তারকারা। সূত্র বলছে, চলতি বছরে উৎসবে বলিউডের কোনও বড় তারকা আসছেন না। তবে শোনা যাচ্ছে, সত্যজিৎ রায় স্মারক বক্তৃতা দিতে উৎসবে আসতে পারেন বর্ষীয়ান গীতিকার কবি গুলজ়ার।
টলিপাড়ার একাংশ অবশ্য মনে করছে, আগুনে ঘি ঢেলেছে ফেডারেশন বনাম পরিচালকদের সংঘাত। চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজনে প্রত্যেক বছর ফেডারেশনের প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে। নন্দন চত্বরে একতারা মুক্ত মঞ্চে সান্ধ্য আড্ডার দায়িত্বে থাকেন ফেডারেশন সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস। মূলত তাঁরই নেতৃত্বে সেখানে মঞ্চ আলোকিত করেন টলিপাড়ার একাধিক তারকা। কিন্তু সূত্রের দাবি, গত কয়েক মাসে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের পরিসর, নারী সুরক্ষা-সহ বিভিন্ন বিষয়ে ফেডারেশনের ‘দাদাগিরি’র যে ভাবে বিরোধিতা করেছেন শিল্পীরা, তাতে ইন্ডাস্ট্রির ‘অভিভাবক’ সংগঠন ক্ষুব্ধ। আবার ফেডারেশন সভাপতি দাবি করেছিলেন, ইন্ডাস্ট্রিতে নারী সুরক্ষা ব্যাহত হওয়ার নেপথ্যে পরিচালকদের একটা বড় অংশ দায়ী। দু’পক্ষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের প্রভাব উৎসবে পড়তে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক টলিপাড়ার এক পরিচালকের কথায়, ‘‘সব কিছুর সীমা আছে। অনেক দিনের জমা ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। ইন্ডাস্ট্রির সদস্যেরা নিজেরাই দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছেন।’’
সংশ্লিষ্ট মহলে খোঁজ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত উঠে আসছে। গত কয়েক বছর চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হত নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। কিন্তু এ বছর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে ধনধান্য প্রেক্ষাগৃহে। টলিপাড়ার এক সূত্রের দাবি, প্রতি বছর নেতাজি ইন্ডোরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে সরকারের প্রায় ৮০ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকা খরচ হত। কিন্তু এ বার টলিউডের একটা বড় অংশই চলচ্চিত্র উৎসবে থাকতে রাজি নয়। তাই কি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরিধি কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে? এই প্রশ্নও উঁকি দিচ্ছে অনেকের মনে। শোনা যাচ্ছে, গত বছরের মতোই অমিতাভ বচ্চন উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসতে রাজি হননি। আসেননি শাহরুখ খান । কিন্তু তাঁর পরিবর্তে কর্তৃপক্ষ সলমন খান এবং অনিল কপূরকে নিয়ে আসেন। কিন্তু এ বছর সে রকম বড় কোনও ব্যক্তিত্ব নাকি আসছেন না। তবে প্রস্তাব গিয়েছে জয়া বচ্চনের কাছে।
প্রত্যেক বছর উৎসবের কয়েক মাস আগে থেকেই নন্দনে সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত টলিপাড়ার শিল্পীদের নিয়মিত বৈঠক হয়। এই বছর সেই বৈঠকেও অনেকেই গরহাজির ছিলেন। তাই উৎসবের প্রস্তুতিও অনেক দেরি করে শুরু হয়েছে বলে খবর। উৎসবের সঙ্গে যুক্ত টলিপাড়ার এক সদস্যের কথায়, ‘‘অনেক নতুন মুখ দেখেছি, যাঁদের সঙ্গে এর আগে চলচ্চিত্র উৎসবের কোনও সম্পর্ক ছিল না। তাঁরা শুধু মিটিংয়ে আসেন এবং শোনেন, তার পর চলে যান।’’
তবে উৎসবে যে জৌলুস কম, প্রচার কম তা মানতে নারাজ উৎসব পরিচালন কমিটির এক সদস্য। তাঁর দাবি, উৎসবের প্রচারের জন্য যা যা প্রয়োজন তা ইতিমধ্যেই করা হয়েছে। উৎসবের মূল আকর্ষণ দেশ-বিদেশের ভাল ছবি। সেখানে কোনও রকম আপস করা হচ্ছে না। অবশ্য, টলিপাড়ার এক অভিনেতার দাবি, উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র অনেকেই পেয়েছেন। তাঁর মতে, পুজোর পর মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে আয়োজিত বিজয়া সম্মিলনীতে টলিপাড়ার একটা বড় অংশ উপস্থিত ছিল। তাই ‘দূরত্ব’ আদৌ কোনও ফ্যাক্টর কি না, উৎসবই তার উত্তর দেবে। উল্লেখ্য, শুক্রবার দুপুরে নন্দনের শিশির মঞ্চে ৩০তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সাংবাদিক বৈঠক। উৎসব ঘিরে যাবতীয় চমকের উপর থেকে পর্দা উঠবে তার পরেই।