CPIM

Bengal polls: সন্ত্রাসের নালিশ বনাম দিদির কাজ

ফলতায় বিজেপি প্রার্থী বিধান পারুইয়ের অভিযোগ, “ফলতায় অবাধে সন্ত্রাস করছে তৃণমূলের জাহাঙ্গিরের দলবল। বাইক বাহিনী বাড়ি বাড়ি হুমকি দিচ্ছে।

Advertisement
অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২১ ০৬:০১
জীর্ণ বৈরাগী-ভিটে ও (ইনসেটে) গোকুল বৈরাগী।

জীর্ণ বৈরাগী-ভিটে ও (ইনসেটে) গোকুল বৈরাগী। নিজস্ব চিত্র।

হাট করে খোলা বাঁখারির গেট। এক বাগান কালকাসুন্দের ঝাড়, ফনফনে ফার্ন সাক্ষ্য দিচ্ছে দীর্ঘ অমনোযোগের। কয়েক পা এগিয়ে বনেদি দোতলা বাড়িটির বাইরের দেওয়ালের পলেস্তারা খসে বেরনো ইট— যেন দাঁত বার করে হো-হো হাসছে, পাগলা মেহের আলির হাসি। চওড়া বারান্দার কোলাপসিব্‌ল গেটে শক্তপোক্ত তালাটা নতুন। কলিং বেলের সুইচ টেপা হল, এক বার, দু’বার। কোথাও কিছু বাজল না। হাঁটু সমান মুথো ঘাস, চোরকাঁটা পেরিয়ে খোলা জানলায় পৌঁছে ডাক দেওয়া গেল অগত্যা—

গোকুলবাবু বাড়ি আছেন?

Advertisement

গোকুল বৈরাগী। ১৯৭৭ থেকে ২০০১ পর্যন্ত সাতগাছিয়া বিধানসভা কেন্দ্র নির্বাচিত করেছে বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে। গোকুলানন্দ বৈরাগী শুধু তাঁর ইলেকশান এজেন্টই ছিলেন না, সাতগাছিয়ার তিনিই ছিলেন ডিফ্যাক্টো বিধায়ক। চৈত্রের ঝাঁ-ঝাঁ দুপুরে জানলা দিয়ে অচেনা ডাক শুনে হাঁক এল ভিতর থেকে— কে?

পরিচয় দিতে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন সে দিনের সেই ডাকাবুকো সিপিএম নেতা— আদুল গা, আটপৌরে লুঙ্গি পরনে। তালা খুলে দিলেন। সাদা কালো চক মিলানো মেঝের বৈঠকখানা। প্রাচীন তক্তপোশে এসে বসার আগে গায়ে গলিয়ে এলেন গোল গলার টি-শার্ট। বললেন, “এক সময়ে ভিড়ে গমগম করত এ-বাড়ি। কেউ আর আসে না— পার্টির লোক, বাইরের লোক, কেউ না। আপনারা যে এসেছেন, আমার খুব আনন্দ হচ্ছে!” নাছোড় উইয়ে খেয়েছে ঢাউস সব জানলার ফ্রেম, পাল্লা। ছাদ থেকে তার সমেত ঝুলছে ওয়্যারিংয়ের কাঠ।

জানালেন, এ বাড়ির অনেক ইতিহাস। আসতেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঠাকুর পরিবারের সেই প্রতিভাবান ছেলে, নিজেকে যিনি উৎসর্গ করেছিলেন সাম্যবাদী আদর্শে। প্রথম বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন ‘দ্য কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’। এ বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা হয় সোমেন ঠাকুরের দল আরসিপিআই-এর। তাঁর সঙ্গী ছিলেন প্রভাস রায়, পলাশ প্রামাণিক। গোকুলবাবুর বাবা শ্রীকৃষ্ণকে সৌমেন্দ্র বলেন, “স্কুল করব, জমি দাও।” পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ বৈরাগী, “ক’কাঠা লাগবে?” সোমেন ঠাকুর বলেন, “বিঘে আঠারো তো বটেই। রাশিয়ার স্কুল কমপ্লেক্সের মতো, সাধারণ স্কুল, আলাদা কৃষি ও শিল্প প্রশিক্ষণের স্কুল। পড়ুয়াদের বল খেলার মাঠও লাগবে।” মুচিশায় ১৮ বিঘে জমিতে আজ দাঁড়িয়ে ‘হরিদাস কৃষি শিল্প বিদ্যাপীঠ’, লাগোয়া আধুনিক স্পোর্টস কমপ্লেক্স। সরবতের গ্লাস হাতে গোকুলবাবুর স্ত্রী বললেন, “সেই সাতগেছিয়াও নেই, দানের মর্মও কেউ বোঝে না। লোকে এখন বলে, কী বোকা গো তোমার শ্বশুর, ১৮ বিঘে উঁচু ডাঙা জমি ইস্কুল গড়তে দিয়ে দিলেন!”

জ্যোতি বসুর সাতগাছিয়ায় এ বারের খবর কী? সপাট উত্তর গোকুলবাবুর, “দুই ফুলের লড়াই হবে। জোড়াফুলের মোহন নস্কর আর পদ্মের চন্দন পাল দাস। সিপিএম আর আছেটা কোথায়!” জানালেন, দলের সদস্যপদটা রেখেছেন।
কিন্তু বাহাত্তরের বৃদ্ধকে ‘তারা আর ডাকে না’।

মুচিশা হাসপাতালের পিছনে অতীত-সম্বল জীর্ণ বৈরাগী-ভিটে অনায়াসে সাতগাছিয়ার সিপিএমের লোগো হতে পারে।

২০১১-য় সোনালি গুহর কাছে হেরে যাওয়া বাম প্রার্থী বরুণ নস্কর বিশালাক্ষী তলার মোড়ে সিপিএমের পথসভার তোড়জোড় করতে করতে জানালেন, সোনালি বিজেপিতে যাওয়ার কোনও প্রভাব এলাকায় নেই। বরুণের কথায়, “তবে ধর্মীয় মেরুকরণের এত হাওয়া কখনও দেখিনি। সেই কারণেই ৬ তারিখ ভোটের ৬ দিন আগেও বলা মুশকিল, ফল কী হবে।” তাঁর যুক্তি, “শাসক দলের সংখ্যালঘু তোষণই এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। পাশের ফলতা, ডায়মন্ড হারবার, বিষ্ণুপুরেও একই ছবি। শাসক দলের ভোট ম্যানেজারদের অনেক হিসেব বদলে দিতে পারে এই ‘ছুপা মেরুকরণ’।” বিষ্ণুপুরে জোড়াফুলের ইস্তাহার বিলির ফাঁকে কর্মী দিগন্ত সর্দারের বরাভয়, “উন্নয়নের কাছে সব ফেল হয়ে যাবে দাদা। ভোটটা দিতে যাওয়ার আগে মানুষ হিসেব করবেন, দিদির কাছে তাঁরা কী পেয়েছেন। আর দিল্লির দাদার দাড়ি যত বাড়ে, তত বাড়ে গ্যাসের দাম।” বিষ্ণুপুরে শাসক দলের প্রার্থী দিলীপ মণ্ডলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে চমকে দিয়ে লোকসভা নির্বাচনেও তিনি ‘ভোট করিয়েছেন’। দিগন্তকে সে কথা বলতেই সলজ্জ হাসি। বলেন, “ভোটটা ভালই বোঝেন দিলীপদা!”

ফলতায় বিজেপি প্রার্থী বিধান পারুইয়ের অভিযোগ, “ফলতায় অবাধে সন্ত্রাস করছে তৃণমূলের জাহাঙ্গিরের দলবল। বাইক বাহিনী বাড়ি বাড়ি হুমকি দিচ্ছে। মারধর করছে আমাদের কর্মীদের। আমাদের দু’জনকে কালও বেদম মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। মেয়েদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করছে। প্রশাসন চোখ বুজে। নির্বাচন কমিশন পুরো ব্যর্থ ফলতায়!” পদ্মের বিধান ২০১৬-য় সিপিএম প্রার্থী ছিলেন এই কেন্দ্রেই। আবার ডায়মন্ড হারবারের বিজেপি প্রার্থী দীপক হালদার গত দু’বার বিধায়ক হয়েছিলেন তৃণমূলের টিকিটে। পুরনো দলের বিরুদ্ধে দীপকের অভিযোগ, “আমি বিধায়ক, দলের একটি গোষ্ঠী আমাকে বাদ দিয়ে ‘কাটমানির সিন্ডিকেট’ প্রতিষ্ঠা করেছে ডায়মন্ড হারবারে। দল পাল্টে প্রাণের হুমকি পাচ্ছি।” এর পর শুক্রবারেই প্রচারে বেরিয়ে মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দীপক। যদিও তৃণমূলের দাবি— ‘গদ্দারদের’ দেখে মানুষ ক্ষিপ্ত হচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু বিজেপির গোষ্ঠী কোঁদলেই মার খেয়েছেন দীপক।

গঙ্গার তীর বরাবর ৯৭ একরে ছড়ানো ফলতার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বাম আমলে তৈরি হয়েছিল বেশ কিছু শিল্প-কারখানা। হাজার ১৪ শ্রমিক-কর্মচারী সেখানে কাজ করতেন। অধিকাংশ ইউনিটই আজ বন্ধ। গেটের বাইরে ‘মা লক্ষ্মী ভাতের হোটেল’-এর মালিক বলেন, “আগে বেলা দুটোর সময়ে রাস্তা পেরোনো যেত না। সাইকেল, গাড়ি, টোটো, অটো, মানুষ। এখন সব খাঁ খাঁ।” তিন জন ডাল-ভাত খাচ্ছেন ভেতরে। তাঁদের দেখিয়ে বললেন, “আগে এই সময়ে লাইন পড়ে যেত। এখন কোনওক্রমে টিকে আছি। ভাল ভাল কর্মীদের ছাড়িয়ে কম পয়সার লোক রাখতে হয়েছে। পয়সা দিই কোত্থেকে বলুন?” সরিষার মোড়ে ভাইজানের জনসভার ভিড়ে বহু কচিকাঁচা। পুলিশ বলছেন, “গাড়ির নম্বর দেখুন, হুগলি-বর্ধমান থেকেও লোক এসেছে।” আবার পৈলান-আমতলায় ‘জাত গোখরো’ মিঠুনের প্রচার যাত্রার জট।

ডুবন্ত সূর্য সোনার কুচি ছড়াচ্ছে ডায়মন্ড হারবারের গঙ্গা-বুকে। ফিনফিনে হাওয়ায় দূরগামী জলযানের দিকে তাকিয়ে ষাটমণিশা হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শাহাদাত আলি শেখের উপলব্ধি— “সব পক্ষই ধর্ম দিয়ে ভোটার গুণছে। এ যে কী বিষাক্ত অভ্যেস! দেশটা যেন কলকাতার মিনিবাস। কন্ডাক্টর ভাই হাঁক পাড়ছেন, পিছন দিকে এগিয়ে চলুন, পিছন দিকে এগিয়ে চলুন!”

আরও পড়ুন
Advertisement