Lok Sabha Election 2024 Results

কুর্সির পথে টানা ৩ বার, দর্পচূর্ণ শরিক-নির্ভরতায়

প্রধানমন্ত্রীর গদিতে মোদী তৃতীয় বার ফিরছেন ঠিকই। কিন্তু আমজনতার পেটের জ্বালা, বেকারত্ব, কর্মসংস্থানের অভাব, মূল্যবৃদ্ধির আঁচ, আয় কমে যাওয়া, কৃষকদের ফসলের দামের মতো রুজিরুটির সমস্যার খেসারত দিতে হল তাঁকে।

Advertisement
প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২৪ ০৭:২১
বিজেপির সদর দফতরে নরেন্দ্র মোদী। মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে।

বিজেপির সদর দফতরে নরেন্দ্র মোদী। মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।

দর্পচূর্ণ করেজনতাই জনার্দন।

Advertisement

নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে এই নিয়ে টানা তিন বার ক্ষমতায় আসার পথে এনডিএ সরকার। পাঁচ বছরের পূর্ণ মেয়াদ পরপর দু’বার শেষ করে এ ভাবে টানা তৃতীয় বার ক্ষমতায় ফেরা গত ছ’দশকে প্রথম। কিন্তু বিজেপি একার শক্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল না। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কিংবা এক ব্যক্তি-এক দলকে কেন্দ্র করে সরকার নয়, বরং ফের জোট শরিকদের উপরে নির্ভরশীল এনডিএ সরকারের প্রত্যাবর্তন ঘটল মঙ্গলবার। একই সঙ্গে, শক্তি বাড়িয়ে সংসদে মজবুত বিরোধী হিসেবে জায়গা করে নিল কংগ্রেস-সহ ‘ইন্ডিয়া’।

প্রধানমন্ত্রীর গদিতে মোদী তৃতীয় বার ফিরছেন ঠিকই। কিন্তু আমজনতার পেটের জ্বালা, বেকারত্ব, কর্মসংস্থানের অভাব, মূল্যবৃদ্ধির আঁচ, আয় কমে যাওয়া, কৃষকদের ফসলের দামের মতো রুজিরুটির সমস্যার খেসারত দিতে হল তাঁকে। রাম মন্দিরের আবেগ কাজ করেনি। অযোধ্যার রাম মন্দির যে লোকসভা কেন্দ্রের আওতায়, সেই ফৈজ়াবাদে বিজেপি হেরেছে সমাজবাদী পার্টির প্রার্থীর কাছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, মানুষের ভোটে জেতা রাজনৈতিক নেতাদের অহঙ্কার গুঁড়িয়ে দিয়ে দেশের আমজনতা বুঝিয়ে দিলেন, কেউ পরমাত্মার পাঠানো দূত নয়। গণতন্ত্রেগণদেবতাই আসল।

লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের পরে আজ নরেন্দ্র মোদী ও রাহুল গান্ধী, দু’জনেই আমজনতার কথা স্মরণ করেছেন। এক দিকে মোদী বলেছেন, তাঁর প্রতি জনতা জনার্দনের বিশ্বাস অটুট রয়েছে। অন্য দিকে রাহুলের দাবি, ‘‘দেশের জনতা নিজেদের সংবিধান বাঁচানোর জন্য লড়বে বলে বিশ্বাস ছিল। সেটাই সত্যি হয়েছে। তাঁরা মোদীকে সাফ বলে দিয়েছেন, আমরা আপনাকে চাই না। নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহকে সরকার চালানোর কাজে চাই না।’’

মোদী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, বিজেপি লোকসভা ভোটে ৩৭০টি আসন বা লোকসভায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে চলেছে। বিজেপি লোকসভায় বৃহত্তম দল হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ২৭২টি আসনই পায়নি। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি একাই ৩০৩টি আসন জিতেছিল। মোদী এ বার এনডিএ-র জন্য ‘চারশো পার’-এর লক্ষ্য স্থির করেছিলেন। অথচ দেখা গেল, পুরো এনডিএ ৩০০-রও কম আসন জিতে দৌড় শেষ করেছে। লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় ২৭২-এর ‘ম্যাজিক সংখ্যা’র থেকে মাত্র গোটা কুড়ি বেশি আসন জিতেছে এনডিএ। সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে স্মৃতি ইরানি, রাজীব চন্দ্রশেখর, অর্জুন মুন্ডা, সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতি, আর কে সিংহ, মহেন্দ্রনাথ পাণ্ডে হেরে গিয়েছেন। নিশীথ প্রামাণিক ও অজয় মিশ্র টেনি, দুই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী হেরেছেন

উল্টো দিকে, সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও ২৩০টির বেশি আসনে জিতে ‘ইন্ডিয়া’ সমস্ত বুথফেরত সমীক্ষাকে ভুল প্রমাণ করেছে। ‘ইন্ডিয়া’র দাবি ছিল, তারা ২৯৫টি আসন জিততে চলেছে। কোনও ভাবেই ‘ইন্ডিয়া’ ২৩০-এর কম আসন পেতে পারে না। বাস্তবিকই তারা ২৩০-এরবেশি আসন জিতেছে। রাহুল-মল্লিকার্জুন খড়্গের নেতৃত্বে কংগ্রেস এক দশক পরে শ’খানেক মতো আসন জিতে ঘুরে দাঁড়ানোর রসদও পেয়েছে। আসনের পাশাপাশি বেড়েছে কংগ্রেসের ভোটের হারও। ভাল ফল করেছে অনেক আঞ্চলিক দল।

রাহুলের দাবি, বিজেপির আসন কমে যাওয়া আদতে মোদীর রাজনৈতিক ও নৈতিক হার। পাল্টা যুক্তিতে মোদী মনে করিয়ে দিয়েছেন, গোটা বিরোধী শিবির একজোট হয়ে যত আসন পেয়েছে, বিজেপি একাই তার থেকে বেশি আসন জিতেছে। আজ লোকসভা ভোটের চিত্র স্পষ্ট হওয়ার পরে মোদী বিজেপির সদর দফতরে গিয়ে বিজেপি তথা এনডিএ-র জয়কে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁর যুক্তি, ছ’দশক পরে দেশের ভোটাররা কোনও জোটকে টানা তিনবার সরকার গঠনের সুযোগ দিচ্ছে। রাহুল বলেছেন, মোদীর আর প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকাই উচিত নয়। মোদী অবশ্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর আগামী পাঁচ বছরের পরিকল্পনারকথা শুনিয়েছেন।

বিজেপির দাবি, দলের আসন কমলেও মোদীর কৃতিত্বকে খাটো করার উপায় নেই। কারণ জওহরলাল নেহরুর পরে তিনিই প্রথম টানা তিনবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইতিহাস গড়তে চলেছেন। গত দুই লোকসভা নির্বাচনে তিনি বিজেপির ঝুলিতে ভোট টেনেছিলেন। এ বার দশ বছর সরকার চালানোর পরে জনমানসে স্বাভাবিক নিয়মে তৈরি ক্ষোভ সত্ত্বেও বিজেপির ভোট আগলে রেখেছেন। বিজেপির ভোটের হার বি‌শেষ কমতে দেননি।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, এই লোকসভা নির্বাচনের ফল নিছক সরকার গঠন, বিরোধীদের শক্তিবৃদ্ধির থেকেও অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। ক্ষমতাসীনের চারশো পারের স্বপ্ন সফল হলে দেশে একনায়কতন্ত্র, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের যে ছায়া ঘনাতে শুরু করত, তা আপাতত সরে গেল। মোদী নিজেকে পরমাত্মার দূত হিসেবে দাবি করে বাস্তবের থেকে নিজের বহুগুণ বড় ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা করছিলেন। সেই বেলুন খানিকটা চুপসে গেল। সংবিধান বদল থেকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের অধিকার খর্ব করা, সংবাদমাধ্যম থেকে বিচারবিভাগের উপরে সরকারি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল। সেই নিয়ন্ত্রণও আলগা হল।

২০২৪-এর লোকসভা ভোটে জিততে মোদী ২০৪৭-এর ‘বিকশিত ভারত’-এর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। রুজিরুটির সমস্যা থেকে নজর ঘোরাতে মুসলিমদের বেশি সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য দুষে, তাঁদের অনুপ্রবেশকারী বলে বিদ্বেষ ছড়াতে চেয়েছিলেন। কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে হিন্দুদের মঙ্গলসূত্র থেকে সম্পত্তি, সব কেড়ে নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে বিলি করে দেবে আতঙ্কও তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিজেপি সরকার চারশোর বেশি আসনে জিতে এলে সংবিধান বদলে দেবে বলে তৈরি হওয়া আতঙ্কের খেসারত দিতে হয়েছে তাঁকে। বি আর অম্বেডকরের সংবিধান বদলে গেলে সংরক্ষণ উঠে যাবে বলে আতঙ্কিত দলিতদের ভোটের এক বড় অংশ বিরোধীদের ঝুলিতে গিয়েছে। যার জেরে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির আসন কমেছে।

উল্টো দিকে, কংগ্রেস তথা বিরোধীরা এক দিকে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সংবিধান বদলের পরিকল্পনা নিয়ে নিশানা করেছে। অন্য দিকে বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মোদী সরকারকে নিশানা করে কংগ্রেস শ্রমিক, মহিলা, কৃষক, তরুণ, অনগ্রসরদের জন্য নানা রকম আর্থিক সুবিধার কথা বলে পাঁচটি ন্যায়, পঁচিশটি গ্যারান্টি নিয়ে ইতিবাচক প্রচার চালিয়ে গিয়েছে। মোদী কংগ্রেসের ইস্তাহারে কী কী করেছে, তা নিয়ে আক্রমণ করতে গিয়ে কংগ্রেসের ইস্তাহারকেই আরও প্রচারের আলোয় নিয়ে এসেছেন।

রাজনৈতিক শিবির মনে করছে, সেনায় মাত্র চার বছরের জন্য নিয়োগের জন্য অগ্নিবীর প্রকল্পের ফলে রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে বিজেপির আসন কমেছে। এই সব রাজ্য থেকে তরুণরা বিপুল সংখ্যায় সেনায় যোগ দেন। গোবলয় তথা হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে বিজেপির দুর্গ অটুট ধরে নিয়ে মোদী দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে আসন বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়েছিলেন। তামিলনাড়ুতে আসন জিততে না পারলেও বিজেপি কেরলে খাতা খুলেছে। অন্ধ্রপ্রদেশেও এ বার বিজেপি আসন জিতেছে। তবে উত্তরপ্রদেশে বিজেপি ধাক্কা খেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির আসন কমেছে। একমাত্র ওড়িশায় লোকসভা ভোটে সাফল্যের পাশাপাশি বিধানসভাও দখল করেছে বিজেপি।

লোকসভা ভোটের গণনার আগে এনডিএ ও ইন্ডিয়া, দুই শিবিরেরই অঙ্ক ছিল, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার ও কর্নাটক— এই পাঁচটি রাজ্যই লোকসভা ভোটের দিশা ঠিক করে দেবে। পাঁচটি রাজ্যেই এনডিএ-র আসন কমেছে। উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বে ‘ইন্ডিয়া’, পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস, মহারাষ্ট্রে দলে ভাঙনের পরে উদ্ধব ঠাকরে-শরদ পওয়ারের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট ও বিহারে তেজস্বী যাদবের নেতৃত্বে জোট বিজেপিকে ধাক্কা দিয়েছে। কর্নাটকে সিদ্দারামাইয়া-ডি কে শিবকুমার জুটির কংগ্রেস বিজেপির আসন কমিয়েছে। আর এই সবের ফল হিসেবেই ‘ইতিহাস গড়েও’ খানিকটা কম প্রতাপ নিয়ে কুর্সিতে ফিরতে হচ্ছে মোদীকে।

আরও পড়ুন
Advertisement