আলিগড়ের সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।
গত কাল রাজস্থানের বাঁশোয়াড়ার পরে আজ উত্তরপ্রদেশের আলিগড়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ফের বললেন, ‘‘কংগ্রেসের নজর আপনার সম্পত্তির উপরে রয়েছে। ক্ষমতায় এলে এরা মা-বোনেদের মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেবে।’’ অনেকের মতে, প্রথম দফায় প্রত্যাশিত ফল হয়নি বুঝেই সরাসরি সাম্প্রদায়িকতার প্রচারে নেমেছেন প্রধানমন্ত্রী। আত্মতুষ্টিতে ভোগা কিংবা দলের উপরে ক্ষুব্ধ হয়ে বসে যাওয়া কর্মীদের উজ্জীবিত করতে এবং বৃহত্তর হিন্দু সমাজকে একজোট হওয়ার বার্তা দিতেই বিভাজনের রাজনীতি উস্কে দিতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী।
সম্প্রতি হায়দরাবাদে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে কোন শ্রেণির হাতে কত সম্পদ আছে তা আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা করে দেখবে। সেই বক্তব্যকে টেনে এনে গত কাল বাঁশোয়াড়ায় মোদী দাবি করেন, ‘‘প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ অতীতে বলেছিলেন, দেশের সম্পদে সর্বাগ্রে অধিকার মুসলিমদের। সেই কারণেই সমীক্ষা করার পরিকল্পনা নিয়েছে কংগ্রেস। যাতে দেশবাসীর কষ্টার্জিত অর্থ মুসলিম ও অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া যায়।’’ মোদীর অভিযোগ, কংগ্রেস মা–বোনেদের সোনারও হিসাব নেবে। মঙ্গলসূত্রকেও ছাড়া হবে না।
রাজনীতির কারবারিদের মতে, এই সব কথা বলে আসলে মোদী হিন্দু মহিলাদের মধ্যে মুসলিম তথা কংগ্রেস সম্পর্কে আতঙ্ক তৈরি করার কৌশল নিয়েছেন। গত কাল সরাসরি বলেছিলেন, কংগ্রেস হিন্দুদের বাড়তি সম্পত্তি মুসলিমদের বিলিয়ে দেবে। আজ আলিগড়ের মতো সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় মুসলিম শব্দটি শুধু উহ্য রেখেছেন। কংগ্রেস সম্পদ কাকে বিলিয়ে দেবে তার উল্লেখ এড়িয়ে যান তিনি। তবে ফের আজ তিনি বলেছেন, ‘‘আমাদের মা-বোনেদের কাছে সোনা থাকে। যা তাঁদের স্ত্রী-ধন ও পবিত্র। এখন এদের নজর পড়েছে মঙ্গলসূত্রে।’’ বিজেপি যে প্রচারে এই ধারাটা বজায় রাখবে, সেটা আজ বিজেপির অন্য নেতাদের কথাতেও পরিষ্কার। কংগ্রেস যতই মিথ্যাচার বলে সরব হোক বা কমিশনের কাছে নালিশ করুক, বিজেপি তার সুর বদলাতে চাইছে না। বিজেপি মুখপাত্র গৌরব ভাটিয়া তাই জোর গলায় বলছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী সত্য কথা বলে কংগ্রেসকে বেআব্রু করে দিয়েছেন বলেই এত সমস্যা। কষ্টার্জিত অর্থ ছিনিয়ে দেওয়ার অধিকার কি কোনও সরকারের থাকে? আর এই কংগ্রেস তথা ইন্ডিয়া জোটের কাছে তো দেশবাসীর চেয়ে অনুপ্রবেশকারীরা অনেক বেশি আপন।’’
লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের গোড়ায় রাম মন্দির নির্মাণ, সরকারী প্রকল্পের সাফল্য, মোদী গ্যারান্টি নিয়ে প্রচারের সুর বেঁধেছিল বিজেপি। নবরাত্রিতে মাংস খাওয়া কিংবা কংগ্রেসের ইস্তাহারে ‘মুসলিম লিগের মনোভাব’ প্রকাশ পাচ্ছে, এ জাতীয় বিক্ষিপ্ত কিছু আক্রমণ ছাড়া সংখ্যালঘু সমাজকে সে ভাবে কাঠগড়ায় তুলতে দেখা যায়নি তাদের। কিন্তু প্রথম দফায় গো-বলয়ে বিশেষ করে এনডিএ শাসিত বিহার, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান এবং পশ্চিমে মহারাষ্ট্রে দলের পক্ষে ভোট কম পড়ায় নড়েচড়ে বসেছেন বিজেপি নেতৃত্ব। প্রবল গরম সত্ত্বেও এ সব রাজ্যগুলিতে যে ভাবে মুসলিম সমাজ ভোট দিতে বেরিয়েছেন, সেই উৎসাহ অনুপস্থিত ছিল হিন্দু সমাজের ভোটারদের মধ্যে। বিজেপি মনে করছে, প্রথম দফায় দলীয় কর্মীদের বড় অংশের মধ্যে ভোট দেওয়ায় প্রবল অনীহা দেখা গিয়েছে। যার একটি কারণ হল আত্মতুষ্টি। দলীয় শীর্ষ নেতৃত্ব গোড়া থেকেই নির্বাচনের আগেই যুদ্ধে জয় হয়ে গিয়েছে বলে প্রচার চালিয়েছিল। যা হিতে বিপরীত হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে তৃতীয় দফায় সরকার গড়া হলে কী কাজ করা হবে তার ঢালাও প্রচারে এক শ্রেণির কর্মী মনে করতে শুরু করেন, দল জিতেই গিয়েছে।
তা ছাড়াও বিজেপির অন্দরের বিশ্লেষণ, এক শ্রেণির কর্মী-সমর্থকেরা দলের প্রতি ক্ষোভেও বসে গিয়েছেন। যাদের কেউ কৃষক, কেউ হয়তো সরকারি সুবিধা পাননি। কারও ক্ষোভ রয়েছে স্থানীয় নেতৃত্বের প্রতি। বিভিন্ন কারণে ক্ষুব্ধ ওই ভোটারেরা ভোটের দিন বাড়ি থেকেই বের হননি। যার প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক ভোটদানে। বিজেপির এক নেতার কথায়, ‘‘পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন বুথে যখন মুসলিমরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে, তখন দলীয় কর্মীদের ঘর থেকে বের করতে কালঘাম ছুটে গিয়েছে।’’ বিজেপির মতে, সেই কারণে প্রচারের তূণ থেকে মেরুকরণের তিরই বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন মোদী।
শুক্রবার দ্বিতীয় দফার ভোট। প্রচার শেষ হবে বুধবারের সন্ধ্যায়। তাই আগামী দু’দিনও সংখ্যালঘু সমাজকে লক্ষ্য করে তীব্র আক্রমণ চলবে বলেই মনে করা হচ্ছে। যদি এই ‘ওষুধে কাজ’ হয়, তা হলে তা নির্বাচনের বাকি পর্বেও ব্যবহার হবে। কংগ্রেস নেতৃত্বের অনুমান, প্রথম দফা ভোটের পরে নাগপুরে এক রাত কাটিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। নাগপুরে সঙ্ঘ পরিবারের সদর দফতর। সম্ভবত এই দাওয়াইয়ের পরামর্শ সেখানেই পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।