Election Violence

ভোট-পরবর্তী হিংসার বলি যুবকের বাড়ি যেন দুর্গ, তবু শঙ্কায় পরিবার

২০২১ সালের ২ মে। সে দিন বিধানসভা নির্বাচনের ভোটগণনা তখনও শেষ হয়নি। ফলাফলের আভাস মিলতেই গাড়ি ভর্তি কয়েকশো লোক ঢুকে পড়েছিল কাঁকুড়গাছির শীতলাতলা লেনে।

Advertisement
চন্দন বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২৪ ০৬:১০
ভোট-পরবর্তী হিংসায় নিহত অভিজিৎ সরকারের স্মৃতি সৌধ। মঙ্গলবার, কাঁকুড়গাছিতে।

ভোট-পরবর্তী হিংসায় নিহত অভিজিৎ সরকারের স্মৃতি সৌধ। মঙ্গলবার, কাঁকুড়গাছিতে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

রেললাইন সংলগ্ন গলির মুখে দু’জন পুলিশকর্মী। গলির ভিতরে ঢুকলে দেখা মিলছে আরও কয়েক জনের। ঘন ঘন পুলিশের গাড়ি ঘুরছে রাস্তায়। থানার ছোট-বড়-মেজো বাবুরা এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছেন। বাড়ির দরজার সামনে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সশস্ত্র দু’জন জওয়ান। তাঁদের কাছে নাম-ধাম লেখানোর পরে সই করলে তবেই মিলছে ঘরে ঢোকার অনুমতি। রেললাইন সংলগ্ন কলোনির একটি ঘরকে এ ভাবেই কার্যত দুর্গে পরিণত করা হয়েছে। ভোটগণনার সকালে তেতলা বাড়ির সামনে এমন পুলিশি সক্রিয়তা দেখে পাড়ার এক যুবক মন্তব্য করলেন, ‘‘এখন এ সব করে কী হবে? দু’বছর আগে এমন তৎপর হলে তো ছেলেটাকে মরতে হত না।’’

Advertisement

২০২১ সালের ২ মে। সে দিন বিধানসভা নির্বাচনের ভোটগণনা তখনও শেষ হয়নি। ফলাফলের আভাস মিলতেই গাড়ি ভর্তি কয়েকশো লোক ঢুকে পড়েছিল কাঁকুড়গাছির শীতলাতলা লেনে। দেদার ভাঙচুর, বোমাবাজির পাশাপাশি ঘিরে ফেলা হয়েছিল বিজেপি কর্মী অভিজিৎ সরকারের বাড়ি। অভিযোগ, গলায় তারের ফাঁস দিয়ে ঘর থেকে টেনে বার করে অভিজিৎকে মারধর করা হয়। মাটিতে ফেলে মাথায় ভারী ইটের টুকরো দিয়ে বার বার আঘাত করা হয়। তাঁর মা, দাদাকেও রেহাই দেওয়া হয়নি। সমাজমাধ্যমে ‘লাইভ’ করে হামলার কথা জানিয়েছিলেন অভিজিৎ। সে দিন দুপুরেই গুরুতর আহত অভিজিৎকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত বলে জানান। ভোট-পরবর্তী এই হামলায় অভিযোগের তির ছিল তৃণমূলের দিকে। গোটা ঘটনা এখনও আদালতে বিচারাধীন।

সেই ঘটনার পরে কেটেছে দু’বছর। এখনও এলাকায় রয়েছে হামলার চিহ্ন— ভাঙা গাড়ি থেকে শুরু করে সিসি ক্যামেরা, ছেঁড়া তার। সে দিন তাঁদের বাড়িও ভাঙচুর করা হয়েছিল বলে জানালেন অভিজিতের দাদা বিশ্বজিৎ সরকার। ঘটনার কয়েক মাস পর থেকে পাশের তেতলা বাড়ির উপরের তলায় মাকে নিয়ে থাকছেন বিশ্বজিৎ। পুরনো বাড়ির পাশের একটি জায়গায় নীচে পড়ে থাকা জানলার ভাঙা কাচের টুকরো দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এখানে ও কুকুর রাখত। ওকে তো মেরে দিলই, কুকুরগুলোকেও ছাড়েনি। ছ’টা কুকুরকে সে দিন ওরা পিটিয়েই মেরে দিয়েছিল। আবার একটা নির্বাচনের ফল। এ বার কী হবে, জানি না!’’

যদিও এ বার আর কোনও ঝুঁকি নেয়নি পুলিশ। ঘটনার পর থেকে আদালতের নির্দেশ মেনে পুলিশি বন্দোবস্ত থাকলেও এ দিন সকালে তা বাড়ানো হয়েছে। তবে তার পরেও আশঙ্কার মেঘ কাঁকুড়গাছির ওই পরিবারে। বড় ছেলেকে চোখের আড়ালে যেতে দিতে চাইছেন না বিশ্বজিতের মা, বছর ষাটেকের মাধবী সরকার। কোনও কাজে বাড়ির নীচে নামলেই বার বার ফোন করছেন, ঘরে চলে আসতে বলছেন। বিশ্বজিৎ জানান, নির্বাচনের ফলাফলের এমন দিনেই তো ঘটনাটা ঘটেছিল। মা চোখের সামনে সবটা দেখেছিলেন। ছেলের এ ভাবে মৃত্যু তাঁকে ভিতর থেকে ভেঙে দিয়েছে। বিশ্বজিতের কথায়, ‘‘মায়ের শরীরে এখন নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। ভাল করে খাওয়াদাওয়া করে না। সারা দিন শুধু কান্নাকাটি করে। মা আর ভাল থাকবে কী করে?’’

নিরাপত্তার ঘেরাটোপ পেরিয়ে তেতলার ঘরে পৌঁছে দেখা গেল, নিজের ঘরে বসে রয়েছেন অভিজিতের মা। বিছানার সামনে রাখা অভিজিতের বড় একটা ছবি। সে দিকে তাকিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে তিনি বললেন, ‘‘সে দিন দু’ঘণ্টা আগে আমার সঙ্গে বসে কত কথা বলল। কিন্তু দু’ঘণ্টা পরে সেই ছেলেটাই আর থাকল না।’’

আরও পড়ুন
Advertisement