Government Scheme

লাভ-ক্ষতি

গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার টাকা আসবে, না কি আটকে থাকবে, সেই সিদ্ধান্তটিও নির্ভর করে কোন দিকের পাল্লায় ভোটের ওজন কতখানি, তার উপরে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২৫ ০৫:০৬

আর্কিমিডিস নাকি বলেছিলেন, আমায় যদি পৃথিবীর বাইরে দাঁড়ানোর মতো একটা জায়গা দিতে পারো, আর যথেষ্ট লম্বা একটা লিভার দিতে পারো, তা হলে আমি পৃথিবীকে স্থানচ্যুত করতে পারব। পদার্থবিদ্যার দুনিয়ায় লিভার-এর মাহাত্ম্য যতখানি, মানবমনের চৌহদ্দিতে ইনসেনটিভ বা প্রণোদনার গুরুত্ব তার তুলনায় কম নয়। ঠিকঠাক প্রণোদনার ব্যবস্থা করা গেলে যেমন গিরিলঙ্ঘন সম্ভব, তেমনই প্রণোদনা বিপরীতমুখী হলে করীও পঙ্কে বদ্ধ হয়ে থাকে। সবচেয়ে বড় মুশকিল, কোনও কাজের ক্ষেত্রে যাঁরা ফলাফল ভোগ করেন, কাজটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার যদি তাঁদের না থাকে, তবে উপভোক্তাদের প্রণোদনা নয়, কাজের চলন নির্ধারণ করে সিদ্ধান্তের অধিকারীদের প্রণোদনা। কথাটি জটিল বোধ হলে হাতেগরম উদাহরণ দেখে নেওয়া যায়— গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনার টাকা। কাজ পাওয়া গেলে, অথবা কাজ করে মজুরি পাওয়া গেলে সাধারণ মানুষের লাভ— ফলে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁদের হাতে থাকলে তাঁরা নিশ্চিত করতেন যে, যোজনার টাকা যেন কখনও আটকে না যায়। সমস্যা হল, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার স্বভাবতই তাঁদের হাতে নেই। সে অধিকার প্রশাসনের— বকলমে নেতাদের। সাধারণ মানুষের উপকারেই তাঁদের প্রণোদনার সুতো বাঁধা, সম্ভবত তাঁরাও সে দাবি করবেন না। তাঁরা চালিত হন একটিমাত্র উদ্দেশে, তার নাম নির্বাচনী লাভ। ফলে, গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার টাকা আসবে, না কি আটকে থাকবে, সেই সিদ্ধান্তটিও নির্ভর করে কোন দিকের পাল্লায় ভোটের ওজন কতখানি, তার উপরে।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গ দাঁড়িয়ে রয়েছে এই ভিন্ন প্রণোদনার আবর্তে। গত তিন বছর যাবৎ কেন্দ্রীয় সরকার একশো দিনের কাজ প্রকল্পের বরাদ্দ টাকা দেয়নি— অভিযোগ, রাজ্যে ভুয়ো জব কার্ড আছে; ফলে অনেকেই অন্যায্য ভাবে প্রকল্পের টাকা পান। ভুয়ো প্রাপককে ঠেকানো নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার জন্য ন্যায্য প্রাপকের টাকা আটকে রাখলে ক্ষতির মাত্রা কোন স্তরে পৌঁছয়, কেন্দ্রীয় সরকার স্বভাবতই সেই প্রশ্নের জবাব দেয় না। একশো দিনের কাজ প্রকল্প গঠনগত ভাবেই দরিদ্রতম মানুষের জন্য— ফলে, এই প্রকল্পের মজুরির টাকা আটকে রাখার অর্থ, সবচেয়ে গরিব মানুষকে ভাতে মারা। মানুষের কথা ভাবার অভ্যাসটি থাকলে কোনও গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষেই এই কাজটি করা অসম্ভব। কিন্তু, বিজেপির লক্ষ্য সম্ভবত ভিন্ন— তারা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চায় যে, তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতির কারণেই তাঁরা প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অবশ্য, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই প্রচার তেমন কার্যকর হয়েছিল, তা বলার উপায় নেই। কেউ অনুমান করতে পারেন, বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে এই টাকা ছেড়ে ভোটের বাজারে প্রভাব ফেলার কথাও ভাবতে পারে বিজেপি।

অন্য দিকে, টাকা আদায় করে আনাতে তৃণমূল কংগ্রেসের যতখানি লাভ, টাকা আটকে থাকলে লাভ তার চেয়ে বেশি। এমনিতেই এনআরইজিএ-র বিকল্প হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী একটি শ্রী-যুক্ত প্রকল্পের সূত্রপাত করেছেন। যে টাকা কেন্দ্রের কাছে প্রাপ্য, তা আদায় না করে রাজ্যের তলানিতে ঠেকা রাজকোষের উপরে আরও চাপ দিয়ে রাজ্যবাসীর কী উপকার হবে, সে প্রশ্ন করা অর্থহীন— এই প্রকল্পের উন্নয়ন-গুরুত্বের চেয়ে ঢের গুরুতর তার রাজনৈতিক ফলের প্রত্যাশা। এনআরইজিএ-র টাকা আটকে থাকলে তা তৃণমূলের হাতে জোড়া অস্ত্র তুলে দেয়— এক দিকে বিজেপি-কে বঙ্গবিদ্বেষী দল হিসাবে প্রচার করার সুযোগ, অন্য দিকে কর্মশ্রী প্রকল্পের মাধ্যমে গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দৃশ্য নির্মাণ। দু’পক্ষেরই যে-হেতু ধারণা যে, টাকা আটকে থাকলেই তাদের রাজনৈতিক লাভ বেশি, ফলে এনআরইজিএ-র টাকা এ রাজ্যে আসে না। তাতে গরিব মানুষের ক্ষতি। উন্নয়নের ক্ষতি। কিন্তু, রাজনীতি আর কবেই বা সেই ক্ষতির হিসাব কষেছে!

Advertisement
আরও পড়ুন