bengal SSC Scam

দুর্নীতি কোথায়

এই রাজ্যের প্রতিটি ক্ষেত্রই মনসবদারি হিসাবে বণ্টিত— কারও ভাগে পড়েছে বালি, কারও কয়লা, কারও মাছের ভেড়ি; আবার কারও ভাগে পড়েছে রেশন, কারও হাসপাতাল, কারও স্কুলের চাকরি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:১২

এসএসসি-কাণ্ডকে কি আদৌ দুর্নীতি বলা চলে? কোনও দেশ বা রাজ্য যে নীতি অনুসরণ করে শাসিত হয়, কিছু দুষ্ট চরিত্রের লোক নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে সেই নীতির ব্যত্যয় ঘটালে তাকে বলা হয় দুর্নীতি। কিন্তু, এসএসসি-কাণ্ডে যা ঘটেছে, যা ঘটে চলেছে— পশ্চিমবঙ্গে তা কোনও মতেই ব্যতিক্রম নয়, তা নিয়ম। এই রাজ্যের প্রতিটি ক্ষেত্রই মনসবদারি হিসাবে বণ্টিত— কারও ভাগে পড়েছে বালি, কারও কয়লা, কারও মাছের ভেড়ি; আবার কারও ভাগে পড়েছে রেশন, কারও হাসপাতাল, কারও স্কুলের চাকরি। ক্ষেত্রগুলি আলাদা, কিন্তু দুর্নীতির চরিত্র অভিন্ন। মনসবদারদের হাতে দেওয়া রয়েছে অন্যায্য খাজনা আদায়ের অধিকার— যে সম্পদের মালিকানা তার নয়, সেই সম্পদের বিনিময়েই শাসক দলের মনসবদাররা খাজনা আদায় করে চলেছেন। এসএসসি-র ক্ষেত্রে যেমন তাঁরা স্কুলের চাকরি বিক্রি করেছিলেন। বিচার চলাকালীন এসএসসি-কাণ্ডের যে কর্মপদ্ধতি প্রকাশ্যে এসেছে, তা এমনই বেপরোয়া, এমনই রাখঢাকহীন যে, সংশয় হয়— দুর্নীতিগ্রস্তরা নিশ্চিত ছিলেন, তাঁদের কিছু হবে না। এই নিশ্চয়তার দু’টিমাত্র কারণ সম্ভব— এক, তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, সরকার এই দুর্নীতিকে কোনও ভাবে প্রকাশ্যে আসতে দেবে না; এবং দুই, দুর্নীতি এখন এমনই স্বাভাবিক যে, এই ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে সাবধান হওয়ার কথা তাঁদের মনেও হয়নি। কারণ দু’টি পরস্পর সম্পর্কহীন নয়। পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতির মনসবদারি মডেল এখন এমনই সর্বব্যাপী যে, তাকেই ‘নীতি’ বলে বিভ্রম হওয়া সম্ভব।

Advertisement

অর্থাৎ, এসএসসি-কাণ্ডটি পশ্চিমবঙ্গে নীতি-অনুসারী প্রশাসনিক পথ থেকে বিচ্যুতির ফল নয়, বরং সরকার ও প্রশাসনের সচেতন চলনই রাজ্যকে এই ভয়ঙ্কর অধ্যায়টির সম্মুখীন করেছে। এবং, সে কারণেই, প্রশাসনিক পথে এর থেকে নিস্তার পাওয়ার সম্ভাবনা কার্যত শূন্য। চাকরিপ্রার্থীরা এই প্রবল গরমেও রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছেন— সোনার পাথরবাটির মতো শুনতে হলেও সরকারের কাছে ‘সুবিচার’ প্রার্থনা করছেন— কিন্তু, সেই সুবিচার দেওয়ার কোনও পথ সরকার বা প্রশাসন নিজেদের জন্য খোলা রাখেনি। বিবিধ কুযুক্তি পেশ করে, আদালতের নির্দেশ মানতে গড়িমসি করে সরকার বড় জোর সমস্যাটিকে কিছু দিনের জন্য পিছোচ্ছে— এ পথে যে সমাধানসূত্র মিলবে না, সরকারও সম্ভবত সে কথা জানে। কোন শিক্ষক কাজ করতে পারবেন, কারা বেতন পাবেন, অশিক্ষক কর্মচারীদের কী হবে, এমন প্রতিটি প্রশ্নেই সরকারের উত্তর অস্বচ্ছ, দায়সারা, গা-বাঁচানো। ব্যতিক্রম হিসাবে দুর্নীতি ঘটলে সেই চক্র ভেঙে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার যদি বা সচেষ্ট হতে পারে, শাসনের ‘স্বাভাবিক’ নিয়মই যদি এই বিপর্যয়ের কারণ হয়, তবে তা থেকে মুক্তির উপায় থাকে না।

এই স্বাভাবিকতার উত্তরে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়াটিও ‘স্বাভাবিক’। তিনি বিক্ষোভকারীদের গরমের মধ্যে বসে না-থাকতে অনুরোধ করেছেন, আপাতত স্কুলে গিয়ে পড়াতে বলেছেন; আশ্বাস দিয়েছেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। অনুমান করা চলে, কর্মচ্যুত শিক্ষকদের অন্তত একাংশকে বিভিন্ন স্কুলে অস্থায়ী শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করা হবে; রোজকোষ থেকে তাঁদের থোক বেতন আসবে। ‘সমাধান’-এর এই মডেলটি পশ্চিমবঙ্গের বিলক্ষণ চেনা— যেখানে অসন্তোষ জন্মায়, সেখানেই সরকার খানিক টাকার ব্যবস্থা করে দেয়। বস্তুত, দুর্নীতির শাসনব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিবিধ অনুদান ‘সেফটি ভাল্‌ভ’-এর কাজ করে। কিন্তু, প্রশ্নটি তো শুধু বর্তমান ২৬,০০০-এর নয়; প্রশ্ন এ রাজ্যের সব তরুণ-তরুণীর। যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি পাওয়া অসম্ভব, এই বিশ্বাস তাঁদের যে ক্ষতি করছে, তা মেরামত করার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের ছিল। মুখ্যমন্ত্রী যদি গোটা ঘটনার দায় স্বীকার করতেন, নিঃশর্তে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন, তবে হয়তো বিশ্বাস করা যেত যে, সরকার নিজের দায়িত্ব ভোলেনি। রাজ্যের দুর্ভাগ্য, আশার সেই ক্ষীণ আলোটুকুকেও মুছে দিচ্ছে রাজনৈতিক ঔদ্ধত্য।

Advertisement
আরও পড়ুন