গত এক দশক ধরে বিশ্ব জুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কুফলগুলি স্পষ্ট ও তীব্র ভাবে অনুভূত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দেশে প্রচলিত পূর্বাভাস দেওয়ার ব্যবস্থাটিকে উন্নততর করা অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেরিতে হলেও সেই প্রয়োজনীয়তা অবশেষে বুঝেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এ ক্ষেত্রে তাদের নবতম উদ্যোগ ‘মিশন মৌসম’। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এই ‘মিশন’-এ সম্মতি জানিয়েছে। দু’বছরের বেশি সময়ের জন্য ২০০০ কোটি টাকা বরাদ্দের এই উদ্যোগটির মূল লক্ষ্য— ভারতের চরম আবহাওয়াজনিত অবস্থা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সংক্রান্ত বিষয়ে পূর্বাভাস দানের ক্ষমতাকে আরও বৃদ্ধি করা। বর্ষা, বাতাসের গুণমান, চরম আবহাওয়া, ঘূর্ণিঝড় এবং কুয়াশা, শিলাবৃষ্টি প্রভৃতি বিষয়ে আরও নিখুঁত এবং সময়নির্দিষ্ট পূর্বাভাসের উপর জোর দেবে এই উদ্যোগ। এই উদ্দেশ্যে আরও ৭০টি ডপলার রেডার, ১০ উইন্ড প্রোফাইলার (বিভিন্ন উচ্চতা থেকে বাতাসের গতি এবং দিক নির্ণয়কারী যন্ত্র) এবং ১০টি রেডিয়োমিটার যুক্ত হবে।
কিন্তু নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় নেই। সৌজন্যে, এ দেশে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির বাস্তবচিত্র। পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বহুল বিজ্ঞাপিত সাম্প্রতিক উদ্যোগগুলি যে ভাবে প্রকৃত সমস্যা সমাধানে এবং প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, তাতে ‘মিশন মৌসম’-এর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অধিকতর আশাবাদী হওয়া মুশকিল। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সাধের ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পের কথা এ প্রসঙ্গে বলা যায়। বহু অর্থব্যয়ে, ঢাক পিটিয়ে তা চালু হলেও গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার লক্ষ্যটি এখনও দূর অস্ত্। আবহাওয়া পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূবিজ্ঞান মন্ত্রক ২০১২-য় চালু করেছিল ‘ন্যাশনাল মনসুন মিশন’। মূল লক্ষ্য ছিল কৃষিনির্ভর দেশটিতে বর্ষার বৃষ্টিপাত সংক্রান্ত পূর্বাভাস আরও জোরদার করা। অতঃপর এক যুগ অতিক্রান্ত। নিঃসন্দেহে পূর্বের তুলনায় পূর্বাভাসব্যবস্থা উন্নততর হয়েছে। কিন্তু দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্ব জলবায়ুর পরিপ্রেক্ষিতে তা কতটুকু? জলোচ্ছ্বাস, হড়পা বান, ভূমিধসের পূর্বাভাসের ব্যবস্থাটি এখনও জোরদার করা যায়নি। ২০১৩-য় কেদারনাথ বিপর্যয়ের পর পূর্বাভাসের বিষয়টি উন্নত করার প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছিল। তার পরও একাধিক প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে। বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি, সম্পত্তিহানি আটকানো যায়নি। কিছু দিন পূর্বে কেরলের ওয়েনাড়ের বিপর্যয়ের পর জিএসআই-এর তরফ থেকে জানানো হয়েছিল, তাদের জেলাভিত্তিক ভূমিধসের সতর্কবার্তার মডেলটি এখনও পরীক্ষামূলক স্তরে আছে। এই বিষয়গুলি এখনও পিছিয়ে থাকলে সার্বিক ভাবে কোনও লক্ষণীয় পরিবর্তন প্রত্যাশা করা চলে না।
একই ভাবে গত বছর ‘গ্লেসিয়াল লেক’ বিপর্যয়ের কারণে সিকিম ও সংলগ্ন অঞ্চলে হড়পা বানের তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করেছে ভারত। জানা গিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কল্যাণে একাধিক হিমবাহ-হ্রদের অবস্থাই বিপজ্জনক। অবিলম্বে এই ধরনের বিপজ্জনক জলাশয়গুলি সম্পর্কে বিশদ ও নিখুঁত তথ্যের প্রয়োজন। সে কাজ কত দূর এগিয়েছে? দেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের-প্রতিরোধী হিসাবে গড়ে তুলতে গেলে শুধুমাত্র ঝড়-বৃষ্টি-খরার পূর্বাভাসই যথেষ্ট নয়। শহর, গ্রাম, প্রত্যন্ত এলাকাও যাতে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকতে পারে, তার ব্যবস্থা করা দরকার। তার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি বিভাগের উন্নতি এবং পারস্পরিক সমন্বয় সাধনের উপর গুরুত্ব আরোপ প্রয়োজন। এই বিষয়টিতে ভারত এখনও বহু পিছিয়ে আছে। এই কারণে, অতিবৃষ্টির পূর্বাভাস মিললেও হড়পা বানের সতর্কবার্তা মিলছে না, ঝড়ের প্রস্তুতি নেওয়া সম্পূর্ণ হলেও বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। ফলে, বহু প্রকল্প, কর্মসূচি, মিশন কাঙ্ক্ষিত ফল লাভে ব্যর্থ হচ্ছে। ‘মিশন মৌসম’-এর কৃতিত্ব নিয়ে ঢাক পেটানোর পূর্বে এই বিষয়গুলি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ভাবনাচিন্তা করুক।