India

দ্বৈরথ

লাদাখে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অবজ্ঞা করিয়া লাইন অব অ্যাকচুয়াল কনট্রোল লঙ্ঘন করা হইয়াছে: মেলবোর্নের কোয়াড বৈঠকে  সর্বসমক্ষে বিস্তারিত বলিয়াছেন জয়শঙ্কর।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৯:৩৩

বেশি বাড় বাড়িলেই যে ঝড়ে পড়িয়া যাইবে, এমনধারা সতর্কবাণী পুরাকালে খাটিত। এই কালে দেখা যায়, বেশি বাড় যাহার, সে-ই আরও বেশি বাড়িতেছে। সাক্ষাৎ প্রমাণ: চিন। অতুলনীয় উদাসীনতা ও আপাত নির্লিপ্ততার সহিত আগ্রাসী নীতির এমন মিশ্রণের উদাহরণ বিশ্ব আগে দেখিয়াছে কি? একবিংশ শতকের চিন প্রমাণ করিয়াছে, তাহার ‘বাড়িবার’ পথে কাহারও কথায় তাহার কিছু আসে-যায় না, তাহার নিজের কথা বলিবারও প্রয়োজন নাই। কথা এবং বার্তা উভয়ই নিতান্ত ‘অপ্রয়োজনীয়’, নিজের উদ্দেশ্যপথে নীরবে এবং সবলে অগ্রসর হওয়াই তাহার মতে ‘শ্রেষ্ঠ’ কৌশল। ভারতের অসীম দুর্ভাগ্য: এ-হেন নির্বিকার, নির্বাক মহাশক্তি কেবল তাহার অতি নিকট প্রতিবেশী নহে, ঘোর শত্রুও বটে। এমন শত্রু, যাহার বিপরীতে অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক— কোনও দিকে ভারতের বিশেষ কোনও অস্ত্র নাই। এমন শত্রু যে ভারতের দুর্গম উত্তর সীমান্ত বরাবর যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি করিয়া রাখিলেও তাহাকে ঠেকানো কঠিন। এমতাবস্থায় নিজের ভূমি রক্ষা করার জন্য ঠিক কোন পথে পা ফেলিতে হইবে, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক স্বার্থ রক্ষার বাস্তবসম্মত পথ কোনটি হইবে, ইহাই ভারতের প্রধান বিবেচ্য। সেই বিবেচনার দিক দিয়া চিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাইবার জন্য ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর যে ভাবে আন্তর্জাতিক মঞ্চকে ব্যবহার করিতেছেন, তাহাকে স্বাগত জানাইতে হয়।

লাদাখে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অবজ্ঞা করিয়া লাইন অব অ্যাকচুয়াল কনট্রোল লঙ্ঘন করা হইয়াছে: মেলবোর্নের কোয়াড বৈঠকে সর্বসমক্ষে বিস্তারিত বলিয়াছেন জয়শঙ্কর। স্পষ্ট করিয়াছেন যে, বিশ্বের বৃহত্তম শক্তিশালীতম দেশগুলির একটি যখন অনায়াসে আন্তর্জাতিক চুক্তি ভাঙিবার দুঃসাহস দেখায়, তখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিষয়টিকে আনিয়া ফেলা ছাড়া উপায় থাকে না। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা রাখঢাক না করিয়া বলিয়াছেন: ভারত ও চিনের সম্পর্ক এখন অসম্ভব কঠিন একটি বিন্দুতে আসিয়াছে। ১৯৭৫ সাল হইতে টানা ৪৫ বৎসর মোটামুটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পর আপাতত পরিস্থিতি ভারসাম্যহীন— যাহার দায় ‘নীরব’ প্রতিবেশীটিকে লইতেই হইবে। প্রসঙ্গত, নীরবতা পালনের পথটি যে সর্বক্ষেত্রে বেজিং মানিয়া চলে, তাহাও নহে। দক্ষিণ চিন সাগরের পরিপ্রেক্ষিতে কোয়াড বা চতুর্দেশীয় অক্ষ যে চিনের প্রতি ‘অযথা’ আক্রমণাত্মক, এই অভিযোগ কিন্তু বেজিং-এর নীরব অধরের ফাঁক গলিয়াই মন্দ্রস্বরে ধ্বনিত হইয়াছে।

Advertisement

সমস্যা তো কেবল চিনকে লইয়া নহে, জয়শঙ্করের দেশটিকে লইয়াও। আন্তর্জাতিক মঞ্চে যে স্পষ্টতার সহিত তিনি বিষয়টির গুরুত্ব উত্থাপন করিলেন, জাতীয় মঞ্চে তাঁহার প্রধানমন্ত্রী কিংবা সরকার কিন্তু সেই স্পষ্টতার ধারকাছ দিয়াও যান না। বরং কথা উঠিলে চিনের মতোই নীরবতাকেই শ্রেষ্ঠ পন্থা মানেন, কিংবা এমন ভাব করেন যেন ভারত চিনকে দিব্য এক প্যাঁচ দিতেছে। লাদাখ অঞ্চলে কী ঘটিতেছে, তাহার যেটুকু স্বীকারোক্তি মেলবোর্নে ধ্বনিত হইল, ভারতে বসিয়া তাহার এক শতাংশও স্পষ্টকথায় শোনা যায় না। রাজনীতি আসিয়া কূটনীতির পথ রোধ করিয়া দাঁড়ায়, নির্বাচনের প্রতিষ্ঠা আসিয়া সীমান্তের বিসর্জনকে আঁচল চাপা দেয়। অথচ নাগরিকের কিন্তু রাষ্ট্রনেতাদের নিকট হইতে সরাসরি সীমান্তসংবাদ জানিবার অধিকার আছে। বিশেষ করিয়া গত কিছু কাল ধরিয়া গলওয়ানে যে পরিস্থিতি, তাহাতে ইহা কেবল জানিবার প্রার্থনা হইতে পারে না, ইহা ভারতের নাগরিকের তথ্যের অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। নরেন্দ্র মোদী সরকার বিষয়টি যে ভাবে মোকাবিলা করিতেছেন, তাহাতে একাধারে বিস্মিত ও অপমানিত না হইয়া পারা যায় না। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার যুক্তিতে নাগরিককে অনিরাপদ বোধ করানো— নির্বিকার অগণতান্ত্রিকতা।

আরও পড়ুন
Advertisement