এই দফায় লক্ষ্য শিল্পায়ন, জানাইলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। ‘ইনফোকম’ সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলিলেন, অদূর ভবিষ্যতেই পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-সম্ভাবনা উজ্জ্বল হইবে। রাজ্যে সামাজিক ক্ষেত্রে যে অর্থব্যয় হইয়াছে, মানবসম্পদের উন্নতির ক্ষেত্রে তাহার প্রভাব; রাজ্যের ‘স্ট্র্যাটেজিক’ অবস্থান এবং স্থল-জল-আকাশ তিন পথেই উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা ইত্যাদির কথা স্মরণ করাইয়া মুখ্যমন্ত্রী বলিলেন, এই রাজ্য লগ্নিকারীদের পছন্দের গন্তব্য হইবার জন্য আদর্শ। শিল্পায়নের কাজে সহায়তা করিতে তাঁহার নেতৃত্বে যে পর্ষদ গঠিত হইয়াছে, মুখ্যমন্ত্রী তাহার কথাও উল্লেখ করিলেন। কথাগুলি যে মিথ্যা, তাহা নহে। দেশের অন্য বহু রাজ্যের তুলনাতেই পশ্চিমবঙ্গে মানবসম্পদ উন্নততর; বহু শহরের তুলনায় কলিকাতায় বসবাস করা আরামদায়ক। তথ্যপ্রযুক্তির ন্যায় ক্ষেত্রে যে এই রাজ্যে কম-বেশি লগ্নি আসিয়াছে, তাহা এই সব কারণেই। ইহাও সত্য যে, দেশের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল এবং অন্তত তিনটি প্রতিবেশী দেশের সহিত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক অবস্থান ঈর্ষণীয়। ফলে, নিছক অর্থনৈতিক যুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গকে উপেক্ষা করিবার কারণ নাই।
কিন্তু, লগ্নি যে শুধু মানবসম্পদ বা জীবনযাত্রার অপেক্ষাকৃত কম খরচ দেখিয়া আসে না, কথাটি রাজ্যবাসী বহু দুঃখে শিখিয়াছে। যে দুইটি প্রশ্নকে লগ্নিকারীরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়া থাকেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সেই প্রসঙ্গ দুইটিতে সর্বদাই নীরব। সেগুলি যথাক্রমে জমি, এবং শিল্পের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও সিন্ডিকেট-রাজ। ডেউচা-পাঁচামিতে জমি অধিগ্রহণের প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রী যে নীতির কথা ঘোষণা করিয়াছেন, ক্ষতিপূরণের পরিপ্রেক্ষিতে তাহা তাৎপর্যপূর্ণ— বস্তুত, সমগ্র দেশেই তাহা মডেল হইতে পারে। কিন্তু, সেই নীতিতেও যে প্রশ্নটির উত্তর মিলে নাই, তাহা এই রূপ— শিল্পের স্বার্থে, রাজ্যের বৃহত্তর স্বার্থে প্রয়োজন হইলে সরকার কি জমি অধিগ্রহণ করিয়া দিবে? দশ বৎসর পূর্বে যে সিঙ্গুর আন্দোলন তৃণমূল কংগ্রেসকে রাজ্যের মসনদে বসাইয়াছিল, আসল জট সেখানেই। রাজ্য সরকার জমি অধিগ্রহণ করিবে, এই কথাটি বলিবার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বাধা বিপুল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীকে বুঝিতে হইবে যে, জমি অধিগ্রহণ করায় বামফ্রন্টের ভুল ছিল না, ভুল ছিল বিধানসভায় সংখ্যাধিক্যের অহঙ্কারে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করায়। সেই ভুল এড়াইয়া অধিগ্রহণের যথাযথ নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন। সিন্ডিকেট-রাজ নিয়ন্ত্রণেও আরও প্রত্যক্ষ এবং সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। দলের মেজো-সেজো নেতাদের অঙ্গুলিহেলনে লগ্নিকারীরা চলিতে বাধ্য হইবেন, এই পরিস্থিতি কোনও ক্রমেই গ্রহণযোগ্য নহে। সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম বলিতেছে যে, মুখ্যমন্ত্রী দলীয় দুর্নীতির প্রশ্নে কঠোরতর অবস্থান লইতেছেন। তাহা যে শুধু সরকারি প্রকল্পের ক্ষেত্রে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণেই সীমাবদ্ধ থাকিবে না, শিল্পক্ষেত্রেও একই নীতি অনুসৃত হইবে, এই আশ্বাসটি স্পষ্ট ভাবে দেওয়া প্রয়োজন।
মুখ্যমন্ত্রী সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে মডেলটি অনুসরণ করিতেছেন, তাহার সম্পূর্ণ ও দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের জন্যই রাজ্যে বড় মাপের শিল্পায়ন প্রয়োজন। সরকারের হাতে টাকা থাকিলে তবেই উন্নয়ন কর্মসূচি তাহার লক্ষ্যে পৌঁছাইতে পারিবে। তথ্যপ্রযুক্তি তো বটেই, নূতন যুগের অন্যান্য শিল্পের জন্যও রাজ্যকে প্রস্তুত করিতে হইবে। ই-বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে তেমনই একটি দিগন্ত খুলিতেছে— ওয়্যারহাউজ়িং, বা পণ্য মজুতের পরিকাঠামো নির্মাণ। তাহাতে বিপুল কর্মসংস্থান সম্ভব। এই রাজ্যে তেমন লগ্নি ইতিমধ্যেই আসিয়াছে। সেগুলির প্রতি যত্নশীল হওয়া বিধেয়। অন্য সম্ভাবনাগুলির দিকেও নজর রাখা জরুরি। রাজ্যকে যদি উন্নতি করিতে হয়, শিল্পায়ন ভিন্ন যে পথ নাই, তাহা কখনও বিস্মৃত হওয়া চলিবে না।