Labour Law

শুধুই বর্জন

কেন্দ্রের চারটি শ্রম বিধির বিরুদ্ধে আপত্তির যথেষ্ট কারণ রয়েছে। যে ভাবে কোভিডকালে প্রায় বিরোধীশূন্য সংসদে শ্রম-বিষয়ক চারটি বিধির কয়েকটি পাশ করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার, বিরোধী দল এবং শ্রমিক সংগঠনগুলির মতামত অগ্রাহ্য করেছে, তা অগণতান্ত্রিক।

শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২৫ ০৪:৪৭

রাজ্য সরকার শ্রম বিধি নিয়ে যা বলছে, কেন্দ্রীয় সরকার বলছে ঠিক তার উল্টো কথা। শ্রমমন্ত্রী তথা আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক বিধানসভায় বলেছেন, কেন্দ্রের শ্রম বিধি গ্রহণ করবে না রাজ্য। নিয়মাবলির খসড়াও প্রকাশ হয়নি। অথচ, কেন্দ্রের শ্রম মন্ত্রক সংসদের শ্রম-বিষয়ক স্থায়ী কমিটিকে লিখিত ভাবে জানিয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার খসড়া নিয়ম তৈরি করে ফেলেছে, তা রাজ্যের শ্রমমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করছে। এমন গুরুতর একটি বিষয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের কথায় এতখানি অসঙ্গতি থাকতে পারে, তা প্রায় অবিশ্বাস্য। শ্রম মন্ত্রক সংসদে ভ্রান্ত তথ্য জমা দিয়েছে, অথবা রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী বিধানসভায় মিথ্যা বলেছেন, কোনওটিই সহজে মেনে নেওয়া যায় না। তবে কঠিন প্রশ্নটি হল, কেন্দ্র যদি চারটি শ্রম বিধি বলবৎ করার বিজ্ঞপ্তি জারি করে দেয়, তা হলে পশ্চিমবঙ্গের শ্রম ক্ষেত্রের ছবিটি কেমন দাঁড়াবে? একই রাজ্যে কেন্দ্রীয় সংস্থায় এবং রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত কলকারখানায় দু’ধরনের আইন-বিধি চলবে। শ্রমিকের নিয়োগ, মজুরি, ছাঁটাই প্রভৃতি নিয়ে অভিযোগের নিষ্পত্তি জটিল হবে। এমনকি, নিষ্পত্তির কর্তৃত্ব কার, তা নিয়েও বিভ্রান্তি দেখা দেবে। সম্ভবত এই পরিস্থিতি এড়াতেই ভারতের অধিকাংশ বিরোধী-শাসিত রাজ্য শ্রম বিধির নিয়মাবলিতৈরি করে ফেলেছে।

কেন্দ্রের চারটি শ্রম বিধির বিরুদ্ধে আপত্তির যথেষ্ট কারণ রয়েছে। যে ভাবে কোভিডকালে প্রায় বিরোধীশূন্য সংসদে শ্রম-বিষয়ক চারটি বিধির কয়েকটি পাশ করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার, বিরোধী দল এবং শ্রমিক সংগঠনগুলির মতামত অগ্রাহ্য করেছে, তা অগণতান্ত্রিক। চারটি শ্রম কোড নিয়ে হতাশা এবং উদ্বেগও কম নয়। সব ধরনের শ্রমিকের জন্য সামাজিক সুরক্ষাকে আবশ্যক করা, সম-কাজে সম-মজুরি, কিংবা মজুরির ক্ষেত্রে পুরুষ-মহিলা বৈষম্য নির্মূল করার বিষয়ে বিধিগুলিতে দৃঢ়তা, আপসহীনতা দরকার ছিল। কিন্তু চারটি নয়া বিধি নানা অস্পষ্টতা রেখে দিয়েছে। মজুরি নির্ধারণের পদ্ধতি, কারখানা-পরিদর্শনের নয়া রীতি প্রভৃতি নিয়েও নানা অভিযোগ উঠেছে। তা বলে, কেবল কেন্দ্রীয় আইনের বর্জনই রাজ্যের নীতি হতে পারে না। কেন্দ্রের শ্রম বিধির কোন বিষয়গুলির প্রতি রাজ্যের আপত্তি এবং কেন, সেই সব বিষয়ে রাজ্যের নিজস্ব নীতি এবং পরিকল্পনা কী, বিধানসভায় তা ব্যাখ্যা করা দরকার ছিল। রূঢ় বাস্তব এই যে, নিয়োগ কিংবা কাজের শর্তের যে সব ব্যবস্থাকে বৈধতা দিয়েছে কেন্দ্রীয় বিধি, তার অনেকগুলি পশ্চিমবঙ্গ-সহ সব রাজ্যে প্রায় নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। যেমন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাজের চুক্তি (ফিক্সড টার্ম কনট্র্যাক্ট) কিংবা বিশ্রামের সময়-সহ বারো ঘণ্টার শিফট। রাজ্য আইনি স্বীকৃতি না দিলেই কি এগুলি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে? রাজ্য সরকার কেন্দ্রের তিনটি কৃষি আইন খারিজ করেছিল, তার মধ্যে ছিল চুক্তি চাষও। কিন্তু চুক্তি চাষ পশ্চিমবঙ্গে ধারাবাহিক ভাবে হচ্ছে, প্রধানত আলুর চাষে। অতএব কেন্দ্রীয় বিধি নস্যাৎ করাই যথেষ্ট নয়। শ্রমিক ও শিল্প, উভয়ের স্বার্থ রক্ষায় কী বিকল্প ব্যবস্থা চিন্তা করেছে রাজ্য সরকার, তা-ও জানাতে হবে।

সর্বোপরি, শ্রম বিষয়টি যে-হেতু রয়েছে যৌথ তালিকায়, তাই কেন্দ্রীয় বিধির বাইরেও নিজস্ব আইন করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে রাজ্যগুলির। যেমন, গিগ ও প্ল্যাটফর্ম কর্মীদের ‘অসংগঠিত শ্রমিক’ বলে ধরেছে কেন্দ্রীয় বিধি, কিন্তু রাজস্থান এবং কর্নাটক তাদের জন্য বিশেষ পর্ষদ নির্মাণ করেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও নিজস্ব উদ্যোগে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু করেছিল ২০০১ সালে, কেন্দ্র এ বিষয়ে আইন আনার সাত বছর আগে। অতএব কেন্দ্রের শ্রম কোডে আপত্তি থাকলে রাজ্য হয় তার নিজস্ব আইন দ্রুত প্রণয়ন করুক, অথবা কেন্দ্রের বিধি মেনে, শিল্প ও শ্রমিকের স্বার্থে ভারসাম্য রেখে, নিয়মাবলি ঘোষণা করুক। বিধি রূপায়ণে রাজ্যের ক্ষমতা যথেষ্ট। নিষ্ক্রিয়তা কোনও বিকল্প নয়।

আরও পড়ুন