আজকের বাজারে দশ টাকা সতেরো পয়সায় কী হয়? ভারত সরকার মনে করে, ওই টাকায় স্বচ্ছন্দে হয় এক জন চোদ্দো বছরের স্কুলপড়ুয়ার উপযুক্ত দুপুরের আহার। যার মধ্যে থাকবে কুড়ি গ্রাম প্রোটিন, ত্রিশ গ্রাম ডাল, পঁচাত্তর গ্রাম আনাজ, যথাযথ তেল-নুন-মশলা, এবং রান্নার গ্যাসের খরচও। পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়ার জন্য ছ’টাকা আটাত্তর পয়সাই নাকি যথেষ্ট। যে বিশেষজ্ঞরা এ সব হিসাব কষেন, তাঁদের স্কুল চালাতে হয় না। তাই হয়তো স্পষ্ট হয় না, অঙ্কের হিসাব আর বাজারের হিসাবে ফারাকটা কতখানি। চালটুকুই কেবল বিনামূল্যে মেলে স্কুলগুলিতে। বাকি সব খরচ কুলোতে হাতে থাকে ওই মাথা-পিছু বরাদ্দ। একটি ডিমের দামই আজ অন্তত ছ’টাকা, ডাল, ভোজ্য তেল এবং জ্বালানির দাম ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী। সে তুলনায়, পিএম-পোষণ (মিড-ডে মিল) প্রকল্পের বাজেটে বরাদ্দ বাড়ছে অতি বিলম্বে, অতি সামান্য। ডিসেম্বর ২০২৪-এর বরাদ্দের উপরে সম্প্রতি কেন্দ্র বাড়িয়েছে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীর জন্য মাথাপিছু ৫৯ পয়সা, এবং উচ্চ প্রাথমিকের শিক্ষার্থীর জন্য মাথাপিছু ৮৮ পয়সা। শিক্ষকদের সংগঠনগুলি স্বভাবতই নানা প্রশ্ন তুলেছে। যেমন, প্রাথমিক ও উচ্চ-প্রাথমিকের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বরাদ্দের ফারাক প্রায় চার টাকা। যা প্রাথমিকে প্রোটিন, ডাল প্রভৃতির জোগানে ঘাটতি রাখতে বাধ্য। শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের একটি সংগঠনের হিসাব, সরকারের বেঁধে দেওয়া পুষ্টি-তালিকা ধরে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের যথাযথ ক্যালরি-সমৃদ্ধ (প্রাথমিকে ৪৫০, উচ্চ-প্রাথমিকে ৭০০) মিড-ডে মিল দিতে গেলে প্রয়োজন কুড়ি টাকা থেকে পঁচিশ টাকা। কম টাকায় কুলোনোর তাগিদে শিশুর পাতের খাবারে থাকে সয়াবিন আর আলুর আধিক্য। মাথাপিছু একটি ডিমের বদলে ডিমের ‘ভুজিয়া’ তৈরি করে কিছু কিছু ছিটিয়ে দেওয়া হয় তরকারিতে।
শিশুদের দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টির মূল্য চোকাতে হবে এই দেশকেই, শ্রমশক্তি, মেধাশক্তির মূল্যে। জিডিপি-র বৃদ্ধির নিরিখে ভারত বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির একটি, কিন্তু শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির নানা সূচক (ওজন, উচ্চতা ইত্যাদি) অনুসারে আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলির সমতুল্য ভারত। সর্বোপরি, পাঁচ বছর অন্তর জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষায় শিশুদের পুষ্টিচিত্রে বিশেষ উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। তা সত্ত্বেও প্রয়োজন অনুসারে টাকা মেলে না। এ বছর কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটে পিএম-পোষণ প্রকল্পে বরাদ্দ বেড়েছে ০.২৬ শতাংশ। ভারতের সরকারি স্কুলগুলিতে শিশু শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি অবধি পাঠরত এগারো কোটি কুড়ি লক্ষ ছাত্রছাত্রীর জন্য মোট বরাদ্দ সাড়ে বারো হাজার কোটি টাকা। কোনও কোনও রাজ্যে পুষ্টিকর খাদ্য জোগানোর বাড়তি খরচ বহন করছে রাজ্য সরকার। যেমন, তামিলনাড়ু সরকার নবম এবং দশম শ্রেণিতেও মিড-ডে মিল চালু রেখেছে, কর্নাটক সরকার সব শ্রেণির ছাত্রছাত্রীকে সপ্তাহে তিন দিন দুধ দিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে, সরকার শিক্ষার্থী-পিছু প্রতি সপ্তাহে বাড়তি কুড়ি টাকা বরাদ্দ করেছিল। মোট বরাদ্দের অঙ্ক ছিল ৩৭২ কোটি টাকা। নির্দেশ দিয়েছিল মুরগি এবং ফল পরিবেশন করতে। নির্বাচন চলে যেতে সে বরাদ্দও চলে গিয়েছে, পরবর্তী নির্বাচনগুলিতে আর ফেরেনি।
দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে যেখানে ডিম, দুধ প্রভৃতি রাজনৈতিক সমর্থনের ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কেন শিশুপুষ্টি সহজেই উপেক্ষিত হয়, সে প্রশ্ন তোলা দরকার। অন্যান্য ব্যবস্থার কথাও চিন্তা করা যেতে পারে। গত বছর শিশু দিবসে একটি ব্যাঙ্কের সহায়তায় বেশ কিছু স্কুলে বিশেষ ভোজের ব্যবস্থা হয়েছিল। এমন ভাবে, সরকারি বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি, বিভিন্ন অসরকারি বা বাণিজ্যিক সংস্থাকে প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলগুলির সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টাকেও সরকার উৎসাহিত করতে পারে। প্রত্যহ ডিম, ডাল যেন থাকে শিশুর পাতে।