Priyanka Gandhi

সম্পর্ক

নাগরিককে ‘স্ব-ক্ষমতা’ অর্জনের অধিকার দেওয়া ভাল, কিন্তু সেই অধিকার যদি খাতায়-কলমেই থাকিয়া যায়, তবে তাহাতে অধিকতর মন্দ সাধিত হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১০:০৭
ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনী প্রচারে কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা এমন একটি কথা বলিলেন, রাজনীতিকদের মুখে যাহা সচরাচর শোনা যায় না। তিনি বলিলেন, অর্থনীতির পরিভাষায় যাহা ‘ডোল’ নামে পরিচিত— দরিদ্র নাগরিকের জন্য রাষ্ট্রপ্রদত্ত অর্থ ও সামগ্রী— তাহা নাগরিকের ক্ষতিসাধন করিতেছে। প্রিয়ঙ্কার মত, নাগরিককে ‘স্বাধীন’ করিবার বদলে তাহা রাজনৈতিক আনুগত্যের বিনিময়ে খুদকুঁড়া ছড়াইবার বন্দোবস্তে পরিণত হইয়াছে। কংগ্রেস নেত্রী বলিয়াছেন, বিনামূল্যে একটি গ্যাস সিলিন্ডার বা খানিক খাদ্যপণ্য প্রদান নাগরিকের ক্ষমতায়ন ঘটায় না— তাহার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা, স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা। রাজনৈতিক আনুগত্যের বিনিময়ে সামান্য সুবিধা প্রাপ্তির এই ব্যবস্থাটি গণতন্ত্রের প্রভূত ক্ষতিসাধন করিতে পারে। উন্নয়ন ও নাগরিক সক্ষমতার ক্ষেত্রে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যে উন্নতির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। যে সরকার প্রতি বাজেটেই এই ক্ষেত্রগুলির বরাদ্দ কার্যত কমাইয়া দেয়, সেই সরকারের নেতারাও মুখের কথায় এই ক্ষেত্রগুলির মাহাত্ম্য স্বীকার করিয়া থাকেন। কিন্তু, শুধু শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা হইলেই সব নাগরিক সমান ভাবে উন্নয়নের পথে অগ্রসর হইতে পারিবেন, এমন দাবি মানিতে অসম্মত হইবেন স্বয়ং অমর্ত্য সেন— অনুমান করা চলে, যাঁহার অর্থনৈতিক-দার্শনিক প্রজ্ঞার ভিত হইতেই প্রিয়ঙ্কা নাগরিকের ‘স্ব-ক্ষমতা’র প্রশ্নটি উত্থাপন করিতেছেন। তাহার জন্য এক-এক জন নাগরিকের এক-এক রকম সাহায্যের প্রয়োজন হইতে পারে। তাহার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। এবং, সেই কর্তব্যপালনে রাষ্ট্রকে বাধ্য করিবার কর্তব্যটি রাজনীতির।

নাগরিকের প্রয়োজন অনুসারে ‘স্ব-ক্ষমতা’র উপাদান জোগাইবার প্রক্রিয়াটি তখনই ন্যায্য, যখন তাহা রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারীদের ইচ্ছাধীন নহে— যখন তাহা নাগরিকের অধিকার। এই বিন্দুটিতেই ‘ডোল’-এর সহিত অধিকারভিত্তিক উন্নয়নের পার্থক্য। ইউপিএ জমানার নীতিনির্ধারণের ভিত্তি ছিল এই অধিকারের প্রশ্নটি। নাগরিকের খাদ্য অথবা কর্মসংস্থানের ন্যায় বিষয় যদি শাসকদের ইচ্ছাধীন না হয়, সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্র যদি এই ব্যবস্থা করিতে বাধ্য থাকে, তবে নাগরিকের স্ব-ক্ষমতার উপাদানগুলি রাজনৈতিক আনুগত্য নির্মাণের প্রকরণ হইয়া উঠিতে পারে না। কল্যাণ অর্থনীতি হইতে অধিকারভিত্তিক অর্থব্যবস্থার প্রস্থানবিন্দু ইহাই। ২০০৪ সাল হইতে ভারত ক্রমে এই নূতন, ন্যায্য পথে হাঁটিতে আরম্ভ করিয়াছিল— ২০১৪ হইতে পশ্চাদপসরণের সূচনা। প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর নাম এবং/অথবা ছবিসমেত যে সুবিধাগুলি নাগরিকের দিকে ইতস্তত ছুড়িয়া দেওয়া হয়, তাহাতে নাগরিকের লাভের ভাবনা গৌণ— সেখানে মূল বিবেচ্য নির্বাচনী লাভ। নির্বাচনী প্রচারসভায় প্রিয়ঙ্কা এই কথাটি বলিয়াছেন দেখিয়া কেহ বিস্মিত হইলে দোষ দেওয়া মুশকিল।

Advertisement

এক্ষণে একটি বৃহত্তর আপত্তিও স্পষ্ট করিয়া দেওয়া জরুরি। নাগরিককে ‘স্ব-ক্ষমতা’ অর্জনের অধিকার দেওয়া ভাল, কিন্তু সেই অধিকার যদি খাতায়-কলমেই থাকিয়া যায়, তবে তাহাতে অধিকতর মন্দ সাধিত হয়। রাষ্ট্রের যদি আর্থিক সামর্থ্য না থাকে, তবে অধিকার ঘোষণা করিলেও তাহা পূরণ করা কার্যত অসম্ভব। এবং, নাগরিকের অধিকাররক্ষায় রাষ্ট্র ব্যর্থ হইলে সেই অধিকারের প্রতি তো বটেই, রাষ্ট্রের প্রতি, সংবিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা কমিবার আশঙ্কা। তাহা নাগরিককে আরও বেশি করিয়া ক্লায়েন্টেলিজ়ম-এর দিকে ঠেলিয়া দিতে পারে। অতএব, অধিকার ঘোষণার ক্ষেত্রে সাবধান। কিন্তু, এই সাবধানতাটি অধিকারের প্রশ্নে কোনও নীতিগত আপত্তিজনিত নহে, তাহা ব্যবহারিক। নাগরিকের সহিত রাষ্ট্রের সম্পর্ক যে আনুগত্যের বিনিময়ে ভিক্ষার তারে বাঁধা থাকিতে পারে না, সেই কথাটি বারে বারে স্মরণ করাইয়া দেওয়া প্রয়োজন। নাগরিকের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থেও।

আরও পড়ুন
Advertisement