উপেক্ষার ইতিহাস

চিঠির দাবি মেনে এই পাহাড়ি জনজাতিরা ব্রিটিশ আওতায় থেকে যান। স্বাধীনতার পরে কাছাড় উপত্যকা ভেঙে নাগাল্যান্ড, মিজ়োরাম, মেঘালয় ইত্যাদি রাজ্য তৈরি হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৩ ০৬:৪৩
An image of

অশান্ত মণিপুর। —ফাইল চিত্র।

ইতিহাস কখনও কখনও চমকে দেয়। তার বিবর্ণ নথিগুলিকেও মনে হয় ভবিষ্যতের ইশারা। বোঝা যায়, উপনিবেশ থেকে স্বাধীন গণতন্ত্র সর্বত্র এক গল্প। যেমন, সংখ্যাগুরুর হাতে জনজাতির নির্যাতনের আশঙ্কা। ১৯২৮ সালের ২৬ মার্চ কোহিমার নাগা ক্লাবের চিঠিটা মনে করা যেতে পারে। তখনকার ভারতবর্ষে শাসনসংস্কার, তাকে ব্রিটেনের অধীনে ডোমিনিয়ন স্টেটাস দেওয়া যায় কি না এই সব খতিয়ে দেখতে সাত সদস্যের সাইমন কমিশন সবে এ দেশে এসেছে। গান্ধী, আম্বেডকর, নেহরু, সকলেই সেই কমিশন এবং সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা নিয়ে উদ্‌ব্যস্ত। লাহোরে লালা লাজপত রায় পুলিশের লাঠিতে নিহত। এই সময়েই কমিশনকে নাগা ক্লাবের ২০ জন সদস্যের স্বাক্ষরিত চিঠি, “শুনছি, আমাদের অজ্ঞাতসারেই নাগা পাহাড়কে আপনারা শাসনসংস্কারের পরিকল্পনায় রেখেছেন। কিন্তু আমরা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে, একই ভাবে থেকে যেতে চাই। অসম উপত্যকা আর মণিপুর রাজ্যের সঙ্গে আমাদের প্রায়ই যুদ্ধ বাঁধত, কিন্তু তারা কোনও দিন আমাদের জয় করতে পারেনি। আমাদের এখানে আটটি জনজাতি, প্রত্যেকের ভাষা ভিন্ন। শিক্ষার হার অত্যল্প।… গরু এবং শুয়োর খাই বলে সমতলের হিন্দু, মুসলিম দুই তরফই আমাদের ঘেন্না করে। আপনাদের প্রস্তাবিত শাসনসংস্কার হলে ভয়, আমাদের ঘাড়ে বেশি করের বোঝা চাপবে। সেই কর দিতে না পারলে এক দিন ওরা আমাদের জমি বেচে দেবে, জন্মভূমির মাটিতে অধিকার থাকবে না। তাই আমরা সরাসরি ব্রিটিশ অধীনেই থাকতে চাই।” স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে আঙ্গামি, সেমা, কাচ্চা গোষ্ঠীর নাগারা আছেন, লেংজাং নামে এক কুকিও আছেন। প্রায় শতবর্ষ আগের আশঙ্কা আজও স্তম্ভিত করে।

চিঠির দাবি মেনে এই পাহাড়ি জনজাতিরা ব্রিটিশ আওতায় থেকে যান। স্বাধীনতার পরে কাছাড় উপত্যকা ভেঙে নাগাল্যান্ড, মিজ়োরাম, মেঘালয় ইত্যাদি রাজ্য তৈরি হয়। সম্প্রতি কুকি জনজাতি মায়ানমার থেকে এ দেশে মাদক, অস্ত্র আমদানি করে বলে বারংবার অভিযোগ উঠলে মণিপুরে তাঁদের শ’তিনেক গির্জা পুড়িয়ে দেওয়া হল। কিন্তু শতবর্ষ আগের আশঙ্কা-ভরা চিঠিটি কেউ মনে রাখল না। যেমন মনে রাখেনি রুশ বিপ্লব, জালিয়ানওয়ালা বাগের সময় ১৯১৭-১৯ সালের কুকি বিদ্রোহের কথা। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা ফ্রান্সের রণাঙ্গনে শক্তসমর্থ কুলি পাঠানোর জন্য মণিপুরের রাজা চূড়াচন্দ্র সিংহকে হুকুম দেয়। এই মেইতেই নৃপতির নামেই আজকের অন্যতম সমস্যাসঙ্কুল এলাকা— চূড়াচন্দ্রপুর। পাহাড়ি নাগা, কুকি জনজাতি মুখ্যত মণিপুর, ত্রিপুরার রাজাদের সৈনিক হিসাবে কাজ করত, ১৯১৭ সালেই মণিপুর থেকে ২০০ জন পাহাড়ি নাগা ও কুকিকে প্রথম দফায় কুলি হিসেবে পাঠানো হয়। মণিপুর দরবারে তখনও ‘পোথাং’ নামে একটি প্রথা চালু। এই প্রথায় সরকারি অফিসারেরা পাহাড়ে গেলে নিখরচায় তাদের বোঝা ও মালপত্র বয়ে দিতে হবে, পাহাড়ে রাস্তা ও ঝোরার উপর সেতু নির্মাণের সময় বেগার শ্রম দিতে হবে। বস্তুত ১৯১৩ সালের আইনে এই প্রথা উঠে গিয়েছিল, কিন্তু তার দশ বছর পরেও কুকিরা অনেকে এই প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। সমতলের আইন মণিপুরের পাহাড়ে তখন ঠিকঠাক প্রয়োগ হত না— উপনিবেশে যেমন ঘটে থাকে।

Advertisement

অতঃপর বিদ্রোহ। গেরিলা যুদ্ধের কায়দায় রাতের অন্ধকারে কুকিরা দু’বছর ধরে মাঝে মাঝেই গ্রামে আসা ব্রিটিশ অফিসার ও দরবারি আড়কাঠিদের উপর হামলা চালাতেন। ৮৬টি কুকি গ্রামকে ব্রিটিশরা নিকেশ করলে কুকিরাও পাল্টা আক্রমণে ৩৪টা গ্রাম পুড়িয়ে ২৮৯ জনকে হত্যা করেন। প্রথম মহাযুদ্ধের শতবর্ষে ভারতীয় সেনার ভূমিকা নিয়ে কয়েক বছর আগেও অনেক বইপত্র বার হল, কিন্তু মূল ধারার ইতিহাসবিদ বা শ্রমিক আন্দোলনের কথাকাররা কুকি বিদ্রোহ নিয়ে নীরবই রইলেন। কেবল রাজনৈতিক নেতারা নন, অন্যান্য সামাজিক বা নারী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দও স্মরণ করলেন না যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ও মণিপুরে মেইতেই-কুকি নির্বিশেষে নারীরা ‘নুপি লান’ আন্দোলন করতেন। মায়ানমার থেকে ব্রিটিশ সরকার এ দেশে চাল আসা বন্ধ করে দিলে স্বামী-পুত্র-কন্যা’সহ পরিবারের মুখে ভাত জোগাতে লাঠি হাতে পথে নেমেছিলেন এই জনজাতিরা। এ এক দীর্ঘ ঐতিহ্য— এক দিকে অবহেলার, অন্য দিকে প্রতিরোধের। প্রজা বলেও পূর্ণ স্বীকৃতি পাননি তাঁরা, নাগরিক হিসাবেও না। মুশকিল হল, হিন্দুত্ববাদীরা ইতিহাসের বিকৃত ব্যাখ্যা করেন, আর প্রগতিবাদীরা মাঝে মাঝেই দুরারোগ্য স্মৃতিভ্রংশের নীরবতায় আচ্ছন্ন হন। দু’টিই কিন্তু অপরাধ, আলাদা ধরনের হলেও!

আরও পড়ুন
Advertisement