Dowry

পণের দাবি

শিক্ষা, সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে যা নিশ্চিহ্ন হওয়ার কথা ছিল, তা ‘অন্য’ রূপে, ক্ষেত্রবিশেষে আরও মার্জিত হয়ে সমাজের মধ্যেই মিশে থেকে ক্রমাগত মেয়েদের গার্হস্থ হিংসার শিকার বানিয়ে চলেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০২৩ ০৪:৫৬
An image representing Dowry

—প্রতীকী চিত্র।

নিরুপমাকে মরতে হয়েছিল তার বাবা পাত্রপক্ষের চাহিদামতো পণের টাকা জোগাড় করতে পারেননি বলে। রবীন্দ্রনাথের ‘দেনাপাওনা’ গল্পের নায়িকার সময় একশো বছরেরও আগের, সমাজ ছিল পশ্চাৎপদ, রক্ষণশীল, শিক্ষার আলোকবঞ্চিত। কিন্তু কেবল পিছিয়ে থাকা, রক্ষণশীল, কম শিক্ষিত সমাজেই পণপ্রথা বলবৎ থাকে— এই ভাবনা অতিসরলীকৃত। সম্প্রতি আমেরিকার দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষা তা নতুন করে ফের প্রমাণ করল। সমীক্ষা বলছে, ভারতীয় পুরুষদের মধ্যে শিক্ষা এবং কাজের সুযোগ যত বৃদ্ধি পেয়েছে, পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে পণপ্রথাও। বিশেষত, গত শতকের চল্লিশ থেকে আশির দশকের মধ্যে এই প্রবণতা ছিল সর্বাধিক। দেখা গিয়েছে, শিক্ষাগত যোগ্যতা, বেতনের নিরিখে পাত্র যত উপরের সারিতে উঠেছে, তার পণের দাবিও সেই অনুপাতে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত, যে পরিবারে কন্যার বিবাহে মোটাটাকা পণ দিতে হয়েছে, অথবা পাত্রের উচ্চশিক্ষার জন্য অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়েছে, সেই পরিবারগুলিতে পণের চাহিদা থেকেছে সর্বাধিক।

শিক্ষা, সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে যা নিশ্চিহ্ন হওয়ার কথা ছিল, তা ‘অন্য’ রূপে, ক্ষেত্রবিশেষে আরও মার্জিত হয়ে সমাজের মধ্যেই মিশে থেকে ক্রমাগত মেয়েদের গার্হস্থ হিংসার শিকার বানিয়ে চলেছে। সমীক্ষা আরও দেখিয়েছে যে, ভারতের সর্বত্র এই প্রথা “বিশ হাজার টাকা পণ এবং হাতে হাতে আদায়”-এর পর্যায়ে আটকে নেই। গবেষকরা ১৯৩০ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ৭৪,০০০-এরও বেশি ভারতীয় বিবাহ পর্যবেক্ষণ করে জানিয়েছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পণপ্রথাতেও বিবর্তন এসেছে। এই তথ্য উদ্বেগের। ১৯৬১ সাল থেকেই ভারতে পণ দেওয়া এবং নেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ, ন্যূনতম পাঁচ বছরের জেল এবং আর্থিক জরিমানার ভয়ও এই কুপ্রথায় প্রভাব ফেলতে পারেনি। গত পাঁচ বছরে উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারে পণজনিত কারণে বধূমৃত্যু হয়েছে যথাক্রমে প্রায় বারো হাজার ও সাড়ে পাঁচ হাজার। তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের স্থানটি চতুর্থ। বলা বাহুল্য, এটা সম্পূর্ণ চিত্র নয়— যে সব ক্ষেত্রে দাম্পত্যসঙ্কটের মুখে কন্যাপক্ষ পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছে, কেবল সেই পরিসংখ্যানই রয়েছে রাষ্ট্রের হাতে। বরং জাতপাতে বহুবিভক্ত সমাজে সম্পদ বৃদ্ধি পেলে তা পণের চাহিদাও বাড়িয়ে তুলেছে।

Advertisement

তবে কি এই নির্যাতনের শেষ নেই? ভাবা গিয়েছিল, নারীশিক্ষার হার যত বাড়বে, মেয়েরা যত স্বনির্ভর হবে, ততই লাগাম পড়বে পণপ্রথায়। এখন দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র প্রথাগত শিক্ষা যথেষ্ট নয়। কারণ, তা সব সময়ে মেয়েদের মধ্যে পুরুষের সম-মর্যাদার বোধ জাগিয়ে তুলতে পারে না। আর্থিক স্বনির্ভরতা মেয়েদের সক্ষমতা অবশ্যই বাড়াতে পারে, কিন্তু সমাজ এবং পরিবারের ভিন্ন ‘শিক্ষা’র বশবর্তী হয়ে বহু মেয়ে স্বেচ্ছায় কাজ ছেড়ে দেয়। পণপ্রথা এক সামাজিক অপরাধ, আরও বহু অপরাধের মূল। কন্যাপক্ষ পণের দাবি মেটালেও কন্যার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হয় না, তার নিদর্শন ঘরে ঘরে। তবু পণপ্রথার প্রতি আজও বিরক্তি জন্মায়নি। পণপ্রত্যাশী পাত্রকে সামাজিক ভাবে প্রত্যাখ্যান না করলে পণপ্রথা যাওয়ার নয়। কঠোর শাস্তি এবং নিরন্তর প্রচার ভিন্ন এ প্রথা থেকে মুক্তি নেই। যৌতুকের নামে আর কত প্রাণ বলি দিলে তবে সমাজ-প্রশাসনের টনক নড়বে?

আরও পড়ুন
Advertisement