PM Narendra Modi

‘পৌঁছ’-সংবাদ

স্পর্ধার পরিমাণটি বিস্ময়াভিভূত করার মতো। সংসদের অভ্যন্তরে সাম্প্রতিক আক্রমণমূলক ঘটনার অভিঘাতে বিরোধীরা দাবি করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি মাত্র।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:১৬
PM Narendra Modi.

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।

সা‌ংসদদের সাসপেন্ড করা এবং তার পর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ করানো— ভারতীয় গণতন্ত্রের নতুন নিম্নমাত্রাটিকে কেবল বিক্ষিপ্ত ঘটনা বলা যাবে না। এর মধ্যে সুপরিকল্পিত ভবিষ্যৎ-ভাবনার ইশারা স্পষ্ট। অবশ্য ‘ইশারা’ শব্দটির মধ্যে পরোক্ষতা আছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গত বুধবার যখন বললেন, এর ফলে যে সব আসন খালি হয়ে গিয়েছে, কোনও চিন্তা নেই— বিজেপিই সেগুলি ভরিয়ে দেবে ২০২৪ সালে, এই ব্যঙ্গকটাক্ষের শব্দে শব্দে প্রত্যক্ষ ভাবেই ঝনঝনিয়ে উঠল তাঁদের মনোবাসনাটি। সেই ‘বাসনা’ অশ্রুত নয়, অপ্রত্যাশিতও নয়। কিন্তু তার এমন তীব্র তীক্ষ্ণ স্পর্ধিত প্রকাশ আগে এ দেশ দেখেছে কি? সম্পূর্ণ অহেতুক ও অসঙ্গত ভাবে প্রায় দেড়শো সাংসদকে লোকসভা ও রাজ্যসভা থেকে সাসপেন্ড করে অনেক যত্নে কৃতে তৈরি সভ্যতাকে নিমেষে ধূলিসাৎ করা গেল। বুঝিয়ে দেওয়া হল, একনায়কতন্ত্র না হলেও একদলতন্ত্র অধিষ্ঠিত-প্রায়। প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসে মোদী ধুয়া তুলেছিলেন কংগ্রেসমুক্ত ভারত চাই বলে। দশ বছরে তাঁর নেতৃত্বে দেশকে এমন জায়গায় এনে ফেলা গিয়েছে যেখানে এখন তাঁরা চান সম্পূর্ণত বিরোধীমুক্ত রাজনৈতিক অঙ্গন, এবং তাঁরা ধারণ করেন সেই লক্ষ্য বাস্তবায়িত করার ক্ষমতা ও কৌশলদক্ষতা। স্পষ্টতই, এ বারের ঘটনা দেখিয়ে দিল বিরোধীমুক্ত দেশ আর কোনও ‘গন্তব্য’ নয়— তাঁরা ‘পৌঁছে’ গিয়েছেন।

Advertisement

স্পর্ধার পরিমাণটি বিস্ময়াভিভূত করার মতো। সংসদের অভ্যন্তরে সাম্প্রতিক আক্রমণমূলক ঘটনার অভিঘাতে বিরোধীরা দাবি করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি মাত্র। কোনও জবাবদিহি নয়, পদত্যাগের দাবি নয়— যে সব কয়টিই হতে পারত দস্তুরমতো গণতন্ত্রসম্মত বক্তব্য। তাঁরা যথেষ্ট আত্মনিয়ন্ত্রণের সঙ্গে মন্ত্রীর বিবৃতি চেয়েই হট্টগোল জুড়েছিলেন। এমন একটি ঘটনার পর মন্ত্রীর সাধারণ ভাবেই বিবৃতি দেওয়ার কথা, কেনই বা তা চাইতে হবে, এটিই একটি প্রশ্ন হতে পারে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এটুকুও যদি বিরোধীরা না বলেন, তা হলে বিরোধী পরিসরটি আছে কী করতে? ‘বাবু’ যা বলবেন, কিংবা বলবেন না, তাতেই যদি সবাইকে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে সম্মত হতে হয়, তা হলে তাঁদের আর ‘বিরোধী’ বলা যায় না, বলতে হয় ‘পারিষদ’— আর গণতন্ত্রের নাম তখন হয়ে যায়— স্বৈরতন্ত্র।

সংসদে হট্টগোল কেন, এ কথা যিনি বা যাঁরা বলছেন, তাঁরা প্রবল দ্বিচারিতার অপরাধে অপরাধী। প্রধান নেতা যা-ই নির্দেশ দিন, অন্য বিজেপি নেতাদের আজ মনে পড়ছে কি, বিরোধী থাকাকালীন তাঁরা বারংবার কী অসামান্য সাফল্যের সঙ্গে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছেন, আরও উচ্চরবে, আরও তীব্র উচ্ছৃঙ্খলতায়। বিশেষত দ্বিতীয় ইউপিএ শাসনকালের শেষ দুই বছর টানা সময়টিই বিজেপি সাংসদরা সম্মিলিত দক্ষতায় সংসদ অচল করে রেখেছিলেন। কেবল বিজেপি নয়, অন্যান্য আমলে অন্য বিরোধী দলের সাংসদরাও এ কাজ করেছেন, বাস্তবিক, এর থেকে অনেক বেশি ‘বাড়াবাড়ি’র দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অবশ্য, কেবল বিজেপি নেতারা নন, বিরোধী রাজনীতির নেতা ও কর্মীদেরও ভাবতে হবে, এবং তার সঙ্গে বৃহত্তর নাগরিক সমাজকেও ভাবতে হবে, গণতন্ত্রের এই অভূতপূর্ব অবনমনে তাঁরা ঠিক কী করছেন। কী ভাবে, এবং কী ভেবে এই হিরণ্ময় নীরবতা তাঁরা পালন করছেন। আজ থেকে দুই দশক আগেও এমন ঘটনা ঘটলে আন্দোলন-মিছিলের বন্যা বয়ে যেতে পারত, ক্ষুব্ধ মানুষ পথে নেমে আসতেন, কেননা তখনকার রাজনীতি অন্তত এটুকু পরিসর ও ভরসা তাঁদের দিত। এখন সব অলীক। কয়েকটি সংবাদমাধ্যম টিমটিম করে বিলাপ করবে, কিছু মানুষ ব্যক্তিগত অসহায়তায় ছটফট করবেন, এই মাত্র। বিরোধী নেতানেত্রীরাও যে নিজেদের ক্ষমতার ঐতিহাসিক নিষ্পেষণের পর এত অমায়িক, নির্বিকার— তাও কি স্বৈরশাসনে স্বীকৃতিছাপ নয়?

আরও পড়ুন
Advertisement