Politics

দেবতা নাই ঘরে

সুস্থচিন্তার ভাগীদার নাগরিক মাত্রেই এই জিজ্ঞাসা পেশ করতে পারেন— এত বিপুল ব্যয়সাধ্য মন্দির-মসজিদ নির্মাণে সরকারি উৎসাহের কারণ কী।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩২
Religion and Politics

—প্রতীকী ছবি।

নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে/ দেবতা নাই ঘরে— বহুপরিচিত রবীন্দ্রকবিতা পঙ্‌ক্তির নিহিত সত্য যেন সত্যতর হয়ে উঠছে প্রতি দিন, এই দেশে। দেবতার ঘর বানানোর নামে প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থসন্ধান এখন ভারতীয় রাজনীতির আবশ্যিক অভিজ্ঞান। একাধারে তা রাজনীতিকেও বিষাক্ত করছে, ধর্মকেও কলুষে ভরে তুলছে। সম্প্রতি শোনা গেল, পশ্চিমবঙ্গের প্রিয় পর্যটনকেন্দ্র দিঘায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি নয়নাভিরাম জগন্নাথ মন্দির তৈরি হচ্ছে, এবং তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওই সমুদ্রশহরে একটি মসজিদও তৈরি হওয়ার কথা চলছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ পরিকল্পনার প্রাথমিক ‘অনুপ্রেরণা’। তিনি নাকি পুরীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিঘাকে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত করতে জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের পরিকল্পনা করেছেন। এবং তার পর জেলার জমিয়তে উলেমা-ই-হিন্দ এবং রামনগর ব্লক জমিয়তে উলেমা-ই-হিন্দের দাবিতে মসজিদের জন্য জমি প্রদান করতে চলেছে তাঁর সরকার— আপাতত সংবাদ। সন্দেহ নেই, মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর পারিষদগণ যা চান, তাই করেন, তাঁদের পথ রোধ করার ক্ষমতা কারও নেই। তবে কিনা, মন্দির-মসজিদ তৈরির এই বিপুল কার্যক্রমের মধ্যে যে-হেতু সরকারি সিদ্ধান্ত মিশে আছে, নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে কিছু প্রশ্ন অন্তত তোলা যায়।

Advertisement

সুস্থচিন্তার ভাগীদার নাগরিক মাত্রেই এই জিজ্ঞাসা পেশ করতে পারেন— এত বিপুল ব্যয়সাধ্য মন্দির-মসজিদ নির্মাণে সরকারি উৎসাহের কারণ কী। পূজা-আরাধনা, সে যে ধর্মেরই হোক— তা নিশ্চয়ই সরকারি কর্মকাণ্ডের মধ্যে পড়ে না? নিশ্চয় সরকারের কিছু উপযুক্ততর কাজ এবং জরুরিতর চিন্তাভাবনা আছে? না কি ইতিমধ্যে মোদী সরকারের রামমন্দির-কেন্দ্রিক জাঁকজৌলুসের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতেই তৃণমূল নেত্রীর এই মন্দির-মসজিদে উৎসাহ দান? বিজেপি ও আরএসএস-এর ‘দৌলত’-এ দেশে এখন দিকে দিকে মন্দির নির্মাণ, মসজিদের তলায় মন্দির-ভগ্নস্তূপ সন্ধান, এবং মসজিদ ধ্বংস একটি প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্য বিজেপি সরকারগুলির সক্রিয়তায় সেগুলি সরকারি কার্যক্রমেও পরিণত হয়েছে। ফলত তৃণমূল কংগ্রেস প্রমুখ দলের কাছেও এই গোত্রের কার্যক্রমই এখন লোকরঞ্জনের বাঞ্ছিত পন্থা। ‘এই গোত্রের’— কেননা স্বাভাবিক যুক্তিতেই বিজেপির মন্দির বানালেই চলে, আর পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে তৃণমূলকে মন্দিরের সঙ্গে মসজিদ বানানোতেও মন দিতে হয়।

সোজা কথা, দিঘার পরিকল্পনা শুনে বুঝতে অসুবিধা হয় না, এর মধ্যে কোনও ধর্মসাধনা বা ধর্মবেদনা নেই, আছে কেবল নির্বাচন-পূর্ব ভোটব্যাঙ্কসেবা। ধর্ম ও রাজনীতির এই যুগপৎ কলুষভার দেখে শুভবোধসম্পন্ন নাগরিকের মাথা আজ হেঁট হয়ে যায় গভীর লজ্জায়, তীব্র উদ্বেগে। ভারতবর্ষের সমাজে চিরদিনই ধারকবাহকের ভূমিকায় ছিল ধর্ম। কোনও দিনই তাতে কোনও বাধা পড়েনি। স্বাধীনতার পর থেকে বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতির এই দেশে রাষ্ট্র ও সরকার সব ধর্ম ও সব সংস্কৃতিকেই মান্য করে চলত। কাজটি সহজ ছিল না। ভুলত্রুটিও অনেক ঘটেছিল। তবু মোটের উপরে সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখা গিয়েছিল। আজ যে ভাবে নেতানেত্রীরা ধর্মস্থান নিয়ে কদর্য রাজনীতি করছেন, তার মধ্যে নিহিত বিপদ কত গভীর সেটা তাঁরা অবহিত আছেন তো?

আরও পড়ুন
Advertisement