ছবি: সংগৃহীত।
সিয়েনা আন্তর্জাতিক ফোটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থানাধিকারী ছবিটিকে লইয়া বিশ্ব জুড়িয়া আলোচনা পড়িয়াছিল সম্প্রতি। সংবাদমাধ্যম হইতে জনমাধ্যম, সর্বত্র ছবিটি ঘুরিতেছিল এই দেশে ওই দেশে। তথ্য ও চিত্রের এই বিস্ফোরণের যুগে ক্রমাগত হিংসা-বিদ্বেষ-নাশকতার সংবাদ-চিত্র-ভিডিয়ো প্রত্যক্ষ করিতে স্নায়ু ইদানীং অভ্যস্ত। এতটাই যে, অসাড় বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। ক্যামেরা-ফোনের দৌলতে ছবি তুলিবার এবং ছড়াইয়া দিবার প্রবণতা এক্ষণে এতই প্রবল, চিত্রগ্রহণের সুযোগ এতই গণতান্ত্রিক, এবং দৃশ্যবস্তুর নিরন্তর জোগানে মনোযোগের মেয়াদ এতই স্বল্প যে, চিত্রের অভিঘাতী ক্ষমতা আজ কত দূর অবশিষ্ট আছে, সেই প্রশ্ন উঠিতে পারে। এমত অবস্থাতেও আবিশ্ব দর্শকের হৃদয় মথিত করিবার মতো শক্তি যে তাহার একেবারে লুপ্ত হয় নাই, পুরস্কৃত ছবিটি তাহাই প্রমাণ করিল।
হার্ডশিপ অব লাইফ নামাঙ্কিত এই ছবিটি তুলিয়াছিলেন তুরস্কের চিত্রগ্রাহক মেহমেট আসলান। ছবিতে দেখা যাইতেছে, এক পিতা দুই হাতে তাঁহার বালকপুত্রকে শূন্যে তুলিয়া ধরিয়াছেন। উভয়েই উভয়ের দিকে চাহিয়া অনাবিল হাসিতেছে। পিতার ডান পা নাই, তিনি ক্রাচে ভর দিয়া দণ্ডায়মান। বালকটির হাত-পা কিছুই নাই। এই পরিবারটি যুদ্ধ-দীর্ণ সিরিয়া হইতে পলাইয়া বর্তমানে তুরস্ক সীমান্তের একটি শহরে শরণার্থী হইয়া বাস করিতেছে। পিতার নাম মুনজির। সিরিয়ার ইদলিব শহরে তাঁহাদের বাড়ি ছিল। সেখানেই একটি বাজারে বোমা বিস্ফোরণে মুনজিরের ডান পা উড়িয়া যায়। বালকপুত্র মুস্তাফা জন্মগত ত্রুটি লইয়াই পৃথিবীতে আসিয়াছে। জন্মাবধি তাহার হাত-পা গঠিত হয় নাই। কেন এমন ঘটিল? ২০১৩ সনে সিরিয়াতে রাসায়নিক গ্যাস সহযোগে যে আক্রমণ হইয়াছিল, তাহার প্রভাবমুক্ত হইতে মুনজিরের স্ত্রী জ়েনিপকে দীর্ঘ দিন ঔষধ সেবন করিতে হইয়াছে। সেই ঔষধের প্রভাবে গর্ভস্থ শিশু প্রতিবন্ধী হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে। কিন্তু মেহমেট আসলান যে মুহূর্তটি ক্যামেরাবন্দি করিয়াছেন, তাহার মূল রসটি বীভৎস নহে, এমনকি শুধুমাত্র করুণও নহে। পিতা-পুত্রের হাস্যোজ্জ্বল দৃষ্টি বিনিময় যেন জীবনের এই ভয়ঙ্কর অস্তিত্বের উপরে এক মোলায়েম স্নেহের আস্তরণ বিছাইয়া দিয়াছে। স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণশক্তির উৎসার কোথাও যেন নাশকতার শক্তিকে পরাভূত করিয়াছে। সম্ভবত সেই কারণেই ছবিটি আক্ষরিক অর্থে মর্মস্পর্শী।
যুদ্ধ-ধ্বংস-নাশকতার ছবির সঙ্গে মানবমনের রসায়ন প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করিয়াছিলেন আমেরিকান চিন্তাবিদ সুসান সনটাগ। রিগার্ডিং দ্য পেন অব আদার্স নামক সেই গ্রন্থে তিনি সতর্ক করিয়া দিয়াছিলেন যে, নাশকতার ছবি সকলের নিকট একই অর্থ বহন করিবে, তা ধরিয়া লওয়া ভুল। দর্শক যদি যুযুধান পক্ষের কেহ না হন, তবে তাঁহার নিকট ধ্বংসের চিত্র যে বার্তা পৌঁছাইবে, বিবদমান গোষ্ঠীর কাছে তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থ থাকিতে পারে। কাহারও মনে তাহা জয়োল্লাস, কাহারও মনে প্রতিশোধের মনোভাব জাগ্রত করিতে পারে। সুতরাং, ‘যুদ্ধবিরোধী ছবি’ নামক ঢালাও কোনও তকমা আদৌ প্রযোজ্য কি না, প্রযোজ্য হইলেও তাহা কার্যকর কি না, ভাবিয়া দেখিবার প্রয়োজন আছে। মেহমেট আসলান কোনও রকম যুদ্ধবিরোধী বার্তা ঘোষণা করেন নাই। বরং তিনি তাঁহার ছবির অতি সাদামাটা নামকরণ করিয়াছেন— হার্ডশিপ অব লাইফ। জীবনের প্রতিকূলতা। এই অতি নিরীহ এবং আপাতসরল নামাঙ্কনের মধ্যেই যেন এক বিকট শ্লেষ উঁকি দিতেছে। নিরাপদ দূরত্বে থাকা দর্শককুলকে সে যেন বলিতেছে, নাশকতার বিনোদনমূল্য আছে জানি। তোমরা শিহরিত হইতে ভুলিয়াছ, তাহা-ও জানি। তোমাদেরই জন্য তাই এক ‘ফিল গুড’ ছবি পেশ করিলাম। তুমি চাহিলে মানবের অসীম সহনক্ষমতা আর জীবনীশক্তিকে প্রথামাফিক কুর্নিশ করিয়া, চাহিলে ‘ওয়াও’ ইমোজি ঠুকিয়া নিদ্রা যাইতে পারো। কিন্তু ছবিটি তোমার স্বপ্নে হানা দিবে না, এমন নিশ্চয়তা নাই। সুসান লিখিয়াছিলেন, যুদ্ধের ছবি আসলে ভুলিতে দেয় না যে, মানুষ মানুষের প্রতি কী অপরিসীম হিংস্রতা নিক্ষেপ করিতে পারে। মেহমেটের ছবি সেই হিংস্রতাকে প্রত্যক্ষ ভাবে পুঁজি করে নাই। ‘শক’ দিবার চেষ্টা করে নাই। পরিবর্তে এক হাস্যমধুর মুহূর্তকে লেন্সে ধারণ করিয়া নীরবে দর্শকের হাসি কাড়িয়া লইয়াছে। কিয়ৎক্ষণ ছবিটির দিকে চাহিয়া থাকিলে এক গভীর লজ্জা মনকে গ্রাস করে। পিতা-পুত্র যেন হাসিমুখে বলিয়া যায় যে, জীবনের এই প্রতিকূলতার জন্য তোমাদিগকে ধন্যবাদ।
যৎকি
ভোট এলে আগে শিলান্যাস হত, এখন প্রকল্পের উদ্বোধন হয়। উত্তরপ্রদেশে আরও একটা এক্সপ্রেসওয়ে খুলে দেওয়া হল। সাঁই সাঁই গাড়ি দৌড়োবে, এক ঘণ্টায় পেরোনো যাবে তিন ঘণ্টার পথ। অবশ্য রাস্তা বানালেই কি পথ খোলে? সে রাজ্যে যেতে চেয়েও তো যাওয়া যায়নি হাথরসে, যেতে চাওয়ার অপরাধে এক বছরের বেশি বিনা বিচারে জেলে আটকে থাকতে হয়েছিল। লখিমপুর খেরির পথে রওনা দিলেও গৃহবন্দি হওয়ার সম্ভাবনা। — যেতে পারো, কিন্তু কেন যাবে?