১২ জন রাজ্যসভার সাংসদের বিরুদ্ধে সাসপেশন প্রত্যাহারের দাবিতে ধরনায় বিরোধী সাংসদরা। ফাইল চিত্র।
অজমের দুর্গের অধিপতি দুমরাজ বড়ই দ্বন্দ্বে পড়িয়াছিলেন— প্রভুর আদেশ মানিয়া বিনাযুদ্ধে মরাঠাকে দুর্গ সমর্পণ করিবেন, না কি দুর্গরক্ষার্থে আমৃত্যু যুদ্ধ করিবার ধর্ম পালন করিবেন? ভারতে বিরোধীরাও আজ এমনই প্রশ্নের সম্মুখে— তাঁহারা কি সংসদে প্রশ্ন তুলিয়া গণতন্ত্রের ধর্ম পালন করিবেন, না কি নীরব থাকিয়া অধ্যক্ষের নির্দেশ মান্য করিবেন? আলোচনার মাধ্যমে প্রশাসনই গণতন্ত্র, সংসদ তাহার প্রাণভ্রমর। কিন্তু বাদল অধিবেশনে কৃষি আইন লইয়া আলোচনা করিতে দেন নাই রাজ্যসভার অধ্যক্ষ। আইন খারিজ করিবার দাবি তুলিয়া শৃঙ্খলাভঙ্গে অভিযুক্ত হইয়াছিলেন বিরোধী সাংসদরা। তাঁহাদের বারো জনকে শীতকালীন অধিবেশনে ‘সাসপেন্ড’ করা হইল। ক্ষমা চাহিয়া সংসদে ফিরিবার সম্ভাবনা উড়াইয়াছেন বিরোধীরা— বরং সাসপেনশনের প্রতিবাদ করিয়া ধর্নায় বসিয়াছেন। তাঁহাদের মতে, এক অধিবেশনে বিধিভঙ্গের জন্য সাংসদদের পরবর্তী অধিবেশন হইতে বহিষ্কার করিবার নিয়ম নাই। কোনও দলের সহিত আলোচনা না করিয়া, এমনকি অভিযুক্ত সাংসদদের আত্মপক্ষ সমর্থন করিবার সুযোগ না দিয়া শাস্তিবিধান অগণতান্ত্রিক। রাজনৈতিক অভিসন্ধির অভিযোগও উঠিয়াছে শাসক দলের বিরুদ্ধে। বারো জন বিরোধী সাংসদ না থাকিবার ফলে রাজ্যসভায় বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ হইবে, এবং তাহার সুযোগে সরকার বিতর্কিত বিলগুলি পাশ করাইয়া লইবে, অভিযোগ করিয়াছে কংগ্রেস। বিজেপি এই সন্দেহ উড়াইতে পারে। কিন্তু সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার লক্ষ্যে সাংসদদের সাসপেন্ড করা হইতেছে, এমন ধারণা যে জনপরিসরে আলোচিত হইতে পারিল, ইহাই শাসক দলের অনপনেয় লজ্জা।
বাদল অধিবেশনে কৃষি আইন খারিজের দাবি করিবার সময়ে বিরোধী সদস্যরা মাত্রা ছাড়াইয়াছিলেন— কেহ এই অভিযোগ করিলে তাহা উড়াইয়া দেওয়া চলিবে না। সচিবালয়ের কর্মীদের টেবিলের উপর উঠিয়া পড়া, অধ্যক্ষের প্রতি ফাইল নিক্ষেপ ইত্যাদি সাংসদ-সুলভ আচরণ নহে। কিন্তু এই শৃঙ্খলাভঙ্গের কিছু দায় কি সরকারের উপরেও বর্তাইবে না? সংসদের যাহা ভূমিকা— প্রশাসন ও উন্নয়ন-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ, সরকারি নীতি এবং কার্যপদ্ধতি লইয়া বিতর্ক— তাহার কতটুকু পরিসর এই সরকার রাখিয়াছে? সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে অতীব গুরুত্বপূর্ণ নানা বিল কোনও বিতর্ক ব্যতীতই পাশ করাইতেছে সংসদে, অগত্যা তাহার প্রতিক্রিয়াতে রাস্তায় নামিতেছে মানুষ। নাগরিকত্ব আইন, কৃষি আইন এবং শ্রমবিধি সংসদে যথেষ্ট আলোচিত হইলে তাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ অবস্থান, হরতাল ইত্যাদির প্রয়োজন পড়িত না। বিরোধী ও সরকারের দ্বন্দ্বে সংসদ অচল হইলে দেশের জরুরি কথাগুলি বলিবে কে, শুনিবেই বা কে?
এই গ্লানিময়, অস্থির অধ্যায়টি মনে করাইল, নিয়মপালন করিবার দায়ের সহিত, নিয়মের ন্যায্যতা লইয়া প্রশ্ন তুলিবার অধিকারও দিয়াছে গণতন্ত্র। প্রশ্নহীন ভাবে বিধিপালনই মানুষের কর্তব্য, এমন নহে। ক্ষেত্র বিশেষে বিধিভঙ্গও কর্তব্য হইতে পারে। তাহা নির্ধারণ করিবে মানুষের বিবেক, বলিয়াছেন মহাত্মা গাঁধী। তিনি লিখিয়াছেন, যদি পিতা তাঁহার উপর এমন বিধি চাপাইয়া দেন যাহা বিবেকের বিরোধী, তাহা হইলে শ্রদ্ধার সহিত তিনি সেই বিধি মানিতে অস্বীকার করিবেন। “যদি পিতাকে সেই কথা বলা শ্রদ্ধাহীনতার পরিচয় না হয়, তাহা হইলে বন্ধুকে, অথবা দেশের সরকারকে সেই কথা বলাও শ্রদ্ধাহীনতা হইতে পারে না,” ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় লিখিয়াছেন গাঁধী। আলোচনাই সংসদের কাজ, অথচ, আলোচনা চাহিলে সংসদের নিয়মভঙ্গ হইবে— এমন দ্বন্দ্বের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বিরোধীরা। নিরসন হইবে বিবেকের নির্দেশে, শাস্তির ভয়ে নহে।