গত দশ বৎসরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে দশটি চিঠি লিখিয়াছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভিতরে জাতপাতের বৈষম্য— প্রধানত দলিত এবং জনজাতির শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ— প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বন্দোবস্ত করিবার নির্দেশ ছিল চিঠিগুলিতে। যেমন, প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে অভিযোগ জানাইবার ব্যবস্থা রাখিতে হইবে, অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান ও প্রতিকারের দায়িত্ব নির্বাহের জন্য কমিটি গঠন করিতে হইবে, ইত্যাদি। বৎসরের পর বৎসর কাটিয়া গিয়াছে, অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এই নির্দেশ পালিত হয় নাই, ইউজিসিও তাহাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা করে নাই। অনেকে নির্দেশ পালনের নামে দায় সারিয়াছে। অন্য দিকে, যেখানে প্রক্রিয়াটি তুলনায় কার্যকর, সেখানে দেখা যাইতেছে অভিযোগের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। এবং এই চিত্রগুলি স্বাভাবিক ভাবে জনসমক্ষে আসে নাই, তথ্যের অধিকার আইন (আরটিআই) মোতাবেক আবেদন জানাইয়া তাহা আদায় করিতে হইয়াছে। সেই পরিসংখ্যানও সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হইয়াছে একটি আলোচনাসভার কল্যাণে, যে সভার আয়োজন করা হয় এক গবেষকের প্রতি সংহতি জানাইবার উদ্দেশ্যে, যিনি বৈষম্যের প্রতিকার দাবি করিয়া অনশন চালাইতেছিলেন। অর্থাৎ, বৈষম্য অব্যাহত, অব্যাহত ঔদাসীন্যের ঐতিহ্যও, প্রবল এবং অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি না হইলে যে ঔদাসীন্যের পাষাণ নড়ে না।
সমাজ বৈষম্যের আকর হইলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাহা হইতে মুক্ত হইবে না, ইহা প্রত্যাশিত। কিন্তু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, এমনকি প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান বলিয়া যাহারা গৌরবান্বিত, তাহাদের অভ্যন্তরেও তফসিলি জাতি ও জনজাতির বিরুদ্ধে বৈষম্যের মাত্রা বাড়িয়া চলিবে এবং তাহার মোকাবিলায় নির্মম নিষ্ক্রিয়তাই অব্যাহত থাকিবে— একুশ শতকের তৃতীয় দশকে এই পরিণতি গভীর লজ্জার। অথচ, সুকঠিন সত্য ইহাই যে, এমন কলঙ্কের সংবাদে আজ আর কেহ বিস্মিত হইবেন না। পূর্বোক্ত আলোচনাসভায় শিক্ষাবিদরা বলিয়াছেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতপাতের বৈষম্য এই দেশে ‘এনডেমিক’-এ পরিণত, অর্থাৎ সমাজ এখন এই মারণব্যাধি আত্মস্থ করিয়া ফেলিয়াছে। কথাটি নির্ভুল। মারণব্যাধি শব্দটি আক্ষরিক অর্থে সত্য: হায়দরাবাদে (২০১৬) রোহিত ভেমুলা বা মুম্বইয়ে (২০১৯) পায়ল তড়বীর ‘আত্মহত্যা’ স্মরণীয়। কিছু শোরগোল হইলেও বাস্তব বদলায় নাই।
প্রশ্ন উঠিতে পারে, উচ্চশিক্ষার আলয়েও কেন এই বৈষম্য? উত্তর সহজ: শিক্ষার প্রসার ঘটিলে জাতপাতের ব্যাধি দূর হইয়া যাইবে, এই বিশ্বাস বহুলপ্রচলিত হইতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহা অতিসরল, সেই বিশ্বাসে জটিল বাস্তবের তল পাওয়া যায় না। বরং পশ্চাৎপদ বর্গের শিক্ষার্থীরা অংশত সাংবিধানিক সুযোগ কাজে লাগাইয়া আপন চেষ্টায় উচ্চশিক্ষার আলয়ে পা রাখিতে পারিলে সেই অগ্রগতি সমাজের অগ্রবর্তী ও সুবিধাভোগী বর্গের অনেকের মনেই বিরূপতার উদ্রেক করে। দলিত জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার রক্ষায় ব্রতী একটি সংগঠনের পরিচালকের কঠোর মন্তব্য: গবেষণা ও অধ্যাপনার ভুবনে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র অটুট রাখিবার উদ্দেশ্যেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতপাতের বৈষম্য চালানো হয়। এই কলঙ্কের দায় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তথা পরিচালকদের উপরেই বর্তায়। বস্তুত, যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৈষম্যের ব্যাধি হইতে নিজেদের বহুলাংশে মুক্ত রাখিতে পারিয়াছে, তাহাদের ব্যতিক্রমী সাফল্যের পিছনে শিক্ষক ও পরিচালকদের ভূমিকাই প্রধান। সেই ভূমিকাই উত্তরোত্তর প্রসারিত হইবার কথা ছিল। অথচ বাস্তবে তাহা বিরল ব্যতিক্রমে পর্যবসিত হইতেছে, এবং বহু ক্ষেত্রেই তাহা ঘটিতেছে ক্ষমতাবান রাজনীতিকদের প্রশ্রয়ে ও প্ররোচনায়। প্রদীপের নীচে অন্ধকার ক্রমে গাঢ়তর হইতেছে।