SSC

ছেলেখেলা

ভুল বানান লুকাইতে খুদে পড়ুয়ারা যেমন খাতায় বিস্তর কাটাকুটি করিয়া রাখে, আদালতের প্রশ্নের সম্মুখে তেমনই এলোমেলো বয়ান দাখিল করিতেছে কমিশন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২১ ০৬:০৪

চঞ্চলমতি বালকদের শাসন করিতে অতীতে শিক্ষকরা তাহাদের বেঞ্চির উপর দাঁড় করাইয়া দিতেন। কলিকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে পশ্চিমবঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশনকে দাঁড়াইতে দেখিয়া সেই দৃশ্য মনে পড়িতে পারে রাজ্যবাসীর। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের মামলায় আদালতের প্রশ্নের সম্মুখে কমিশন যে রূপ নাকাল হইতেছে, তাহার সহিত বিপাকে পড়া দুষ্ট বালকের মিল অনেকই। তবে না, বিষয়টি কৌতুকের নহে, অত্যন্ত গুরুতর। এই নিয়োগের বিষয়টিতে ক্রমান্বয়ে যে বিপুল দুর্নীতির সাক্ষ্য সম্মুখে আসিতেছে, তাহা সত্যই বিস্ময়কর। সরকারি নিয়মের লাল ফিতায় আটকাইয়া সরকারি সংস্থাগুলি মন্থর, অসংবেদনশীল এবং অদক্ষ হইয়া পড়ে, সেই সঙ্কটের সহিত রাজ্যবাসী পরিচিত। কিন্তু সরকারি নিয়মবিধিকে কোনও দফতর একেবারে নস্যাৎ করিয়া বসিয়া আছে, রাজনৈতিক প্রভাবের নির্লজ্জ অঙ্গুলিহেলনের উপর নিয়মরক্ষার শাকটুকুও চাপাইবার প্রয়োজন বোধ করিতেছে না, ইহা প্রায় অবিশ্বাস্য। অথচ, এখনও অবধি স্কুল সার্ভিস কমিশনের কর্তারা যে সকল বক্তব্য পেশ করিয়াছেন আদালতে, তাহা রীতিমতো বেআব্রু। যথা, যাঁহারা গত এক বৎসর সরকারি কর্মচারী হিসাবে সরকারি স্কুলগুলিতে কাজ করা এবং বেতনপ্রাপ্ত পঁচিশ জন কর্মীকে কমিশন নিয়োগ করে নাই, নিয়োগের কোনও তথ্যও নাই। এই হলফনামার পরেই ওই কর্মীদের নিয়োগের সুপারিশপত্র আদালতে দাখিল করিল মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। অতঃপর কমিশনের তরফে জানানো হইল, তাহারা সুপারিশ দেয় নাই। ভুল বানান লুকাইতে খুদে পড়ুয়ারা যেমন খাতায় বিস্তর কাটাকুটি করিয়া রাখে, আদালতের প্রশ্নের সম্মুখে তেমনই এলোমেলো বয়ান দাখিল করিতেছে কমিশন।

চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর নিয়োগ লইয়া এই মামলা হইলেও, নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ এই প্রথম নহে। উচ্চপ্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও প্রায় একই সমস্যা সম্মুখে আসিয়াছিল। নিয়োগের পরীক্ষার ফল এবং অন্যান্য যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রস্তুত তালিকায় প্রার্থীদের অবস্থান, পরের প্রার্থী আগে সুযোগ পাইবার অভিযোগ, অথবা তালিকা-বহির্ভূত প্রার্থী নিযুক্ত হইবার অভিযোগ বার বার উঠিয়াছে। আদালতে মামলা চলিয়াছে, প্রার্থীরা নানা আন্দোলন করিয়াছেন। স্কুলের শূন্য পদ পূরণ করিতে দীর্ঘ বিলম্ব হইয়াছে, আদালতে বিচারপ্রার্থীর সংখ্যা বাড়িয়াছে, বিচারপতিদের সময় নষ্ট হইয়াছে। এই কি প্রশাসনিক দক্ষতার নমুনা? যে কোনও সরকারি আধিকারিক ফাইল দেখিয়া যে ত্রুটিগুলি চিহ্নিত করিতে পারেন, তাহার জন্য আদালতের বিচারপতির সময় নষ্ট কেন? কেন স্বচ্ছতার সহিত নিয়োগের পরীক্ষায় বার বার ফেল করিতেছে কমিশন? কমিশনের ব্যর্থতার অর্থ, অগণিত শিশুর শিক্ষাবঞ্চনা, যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগের সুযোগ হইতে বঞ্চনা। বিভ্রান্তিকর তথ্য দাখিল করিয়া আদালতের সময় নষ্ট করাও কি এক অর্থে আদালতের অবমাননা নয়?

Advertisement

প্রশ্ন অসংখ্য। সাধারণ প্রশাসনিক কার্যধারায় যে সকল অনিয়ম ঘটিতে পারা অসম্ভব, তাহা বার বার ঘটিতেছে কী করিয়া? সরকারি কাজের স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হইতেছে কেন? সেই অদৃশ্য কারণের প্রতি ইঙ্গিত করিয়াই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় কমিশনের উপর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির প্রস্তাব তুলিয়াছেন। চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নিয়োগে অনিয়মের তদন্তে সিবিআই নিয়োগ— ইহার চাইতে লজ্জাজনক আর কী হইতে পারে রাজ্যের নিকট? আরও বিস্ময়কর শিক্ষামন্ত্রীর মন্তব্য। তিনি জানাইয়াছেন, দায়িত্ব গ্রহণ করিবার পূর্বে কী হইয়াছিল, তিনি জানেন না। শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ, স্কুল আসিবার পূর্বে পাঠ তৈরি করিতে হয়, তাহা স্কুলছাত্র শিশুও জানে; মন্ত্রীর আসনে বসিবার জন্যও কিছু হোমওয়ার্ক জরুরি নয় কি?

আরও পড়ুন
Advertisement