লোকাল ট্রেন ফের চালু হইল পশ্চিমবঙ্গে, এবং প্রথম দিনেই মাত্রা ছাড়াইল যাত্রী-সংখ্যা। রাজ্যবাসী দেখিলেন, ট্রেনযাত্রীদের কোভিড-বিধি মানিতে বাধ্য করিবার উপায়ও হাতে নাই প্রশাসনের, বিধিভঙ্গের শাস্তি দিবার ক্ষমতাও নাই। অথচ, ট্রেনযাত্রা সুরক্ষিত করিবার কাজটি যে কঠিন হইবে, সেই কথা তো অজানা ছিল না। ট্রেনের আসনের পঞ্চাশ শতাংশের অধিক যাত্রী নিষিদ্ধ করিল রেল— কিন্তু কী প্রকারে সেই নিষেধাজ্ঞা পালিত হইবে, কোন উপায়ে যাত্রীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত হইবে, তাহার কোনও ব্যবস্থাই করে নাই। যাত্রীদের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখিবার বিধি প্রচার করিল, কিন্তু তাহা মানিবার উপযোগী ব্যবস্থা হইল না। মুখোশহীন যাত্রীদের জরিমানা করিবার সতর্কবার্তা প্রচার করিবার পরেও, মাত্র পাঁচ জনকে মৃদু সতর্ক করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছেন রেলকর্তারা। দেহের তাপমাত্রা মাপিবার ব্যবস্থা করিয়াও কার্যকালে তাহার প্রয়োগ হইল না। লোকাল ট্রেন ফিরিল তাহার প্রাক্-অতিমারি চেহারায়— কামরাগুলিতে তিলধারণের স্থান নাই, ভিড়ের চাপে বহু যাত্রী উঠিতে পারেন নাই ট্রেনে, মুখোশ-প্রভৃতি সুরক্ষার তোয়াক্কা না করিয়াই বহু মানুষ ট্রেনযাত্রা করিতেছেন। গত দেড় বৎসর কোভিড সম্পর্কে বহু ব্যয়ে, বহু কৌশলে যে সকল সতর্কবার্তা প্রচার করিয়াছে সরকার, একটি লোকাল ট্রেন সেগুলি সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ করিবার পক্ষে যথেষ্ট।
তাই আজ প্রশ্ন উঠিবে, যে দীর্ঘ সময় লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকিল, তাহার মধ্যে কি যাত্রীদের উপর নজরদারি ও ভিড় নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা প্রস্তুত করা সম্ভব ছিল না? মেট্রো রেল টিকিট কাটিবার নিয়মে পরিবর্তন আনিয়া, এবং যাত্রীদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করিয়া অতিরিক্ত ভিড় এড়াইয়াছে। লোকাল ট্রেনের ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট সংখ্যায় টিকিট বিক্রয়, স্টেশন ও প্ল্যাটফর্মের প্রবেশপথে বিশেষ পরীক্ষা, ক্যামেরা-সহ নানাবিধ প্রযুক্তির প্রয়োগে বিধিভঙ্গকারীদের চিহ্নিত করা যাইতে পারিত। তাহার চেষ্টা কি হইয়াছিল? ট্রেনযাত্রা হইতে কোভিড সংক্রমণ যাহাতে না ছড়াইতে পারে, জনস্বাস্থ্য যথাসম্ভব সুরক্ষিত থাকিতে পারে, তাহার জন্যই তো সরকার এক বৎসরেরও অধিক সময় লোকাল ট্রেন বন্ধ রাখিয়া, কেবল অল্প সংখ্যায় ‘স্পেশাল ট্রেন’ চালাইয়াছে। তাহার ফলে অগণিত মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাইতে হইয়াছে। জীবিকা রক্ষার তাগিদে তাঁহারা বাসে অথবা ভাড়া গাড়িতে ঠাসাঠাসি করিয়া যাতায়াত করিয়াছেন। তাহার খরচ সাধ্যাতীত, সুরক্ষা শূন্য। সরকারি কর্মীদের জন্য নির্দিষ্ট স্পেশাল ট্রেনে সাধারণ যাত্রী উঠিবার চেষ্টায় কত অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়াছে, হিসাব নাই। এখনও তুলনায় কমসংখ্যক ট্রেন চলিতেছে। যেখানে যাত্রী-সংখ্যা বিপুল, এবং ট্রেনে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করার গুরুত্ব অসীম, সেখানে ট্রেনের সংখ্যা কমাইয়া কী উপকার হইতেছে, রেল দফতরই জানে।
এই বারের ঝুঁকির যাত্রা শুরু হইল এমন সময়ে, যখন করোনা সংক্রমণ ফের ঊর্ধ্বমুখী হইয়াছে, অতিমারির তৃতীয় ঢেউ আসিবার ইঙ্গিত মিলিতেছে। এই ভাবেই ভারতীয় রাজনীতিতে প্রশাসকদের সিদ্ধান্তগুলি তাঁহাদের সদিচ্ছার ঘোষণা হইয়া থাকিয়া যায়। ঘোষণাগুলিকে কার্যে পরিণত করিবার প্রয়োজন কেহ অনুভব করেন না। তাই লকডাউন বিধি বলবৎ থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনী জনসভা করিবার, অথবা পূজামণ্ডপে লোক প্রবেশের অনুমতি দিবার মধ্যে প্রশাসনের কর্তারা অসঙ্গতি দেখিতে পান না। নাগরিকও বুঝিয়াছেন, বিধি কেবল ঘোষণার জন্য, পালনের জন্য নহে। তাই তাঁহারাও কোভিড বিধিকে তুচ্ছ করিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। অবশ্য গণপরিবহণ যাঁহাকে ব্যবহার করিতে হয়, তাঁহার পক্ষে আত্মরক্ষা প্রায় অসম্ভব। হয়তো তাহা বুঝিয়াই এত মানুষ জনপূর্ণ স্থানে সুরক্ষাহীন অবস্থায় বেড়াইতেছেন। লোকাল ট্রেন সেই আত্মঘাতী নীতিরই প্রকাশ।