এক বৎসর ধরিয়া চলা আন্দোলন যাহা পারে নাই, পঞ্জাব-উত্তরপ্রদেশের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনই কি তাহা করিয়া দেখাইল? সাতশতাধিক প্রাণহানিতেও যে হুকুম নড়ে নাই, ভোটের বিপদ দেখিয়াই কি হাকিম ছলোছলো চোখে তাহা প্রত্যাহার করিয়া লইলেন? তিন বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহারের প্রেক্ষিতে স্বভাবতই এই প্রশ্ন উঠিতেছে। দেশবাসীর স্মরণে আছে যে, যত বার আইন প্রত্যাহারের দাবি উঠিয়াছে, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিরা বলিয়াছেন, তাহা অসম্ভব। কারণ, এই আইনটির সহিত প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা জড়াইয়া আছে। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্নও সরকারকে এই অবস্থান হইতে নড়াইতে পারে নাই। দিনের পর দিন, প্রবল শীত, প্রবলতর গ্রীষ্ম সহিয়া মানুষ রাস্তায় পড়িয়া থাকিয়াছেন। জবাবে কেন্দ্রীয় সরকার দিল্লির সীমান্তগুলিকে দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করিয়াছে। কিন্তু, কৃষকদের দাবিতে কর্ণপাত করে নাই। শুধু ভোটের টানেই সেই অবস্থান পাল্টাইয়া গেল? তাহা হইলে প্রশ্ন উঠে যে, এই সরকারের নিকট গণতন্ত্র, প্রশাসনিকতা, কিছুরই কি কোনও দাম নাই, নির্বাচনই মোক্ষ? ঘটনাক্রম বলিতেছে, আইন প্রত্যাহারের সম্ভবত আর কোনও কারণ নাই। নির্বাচনী গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলি সেই স্বার্থের কথা মাথায় রাখিয়া চলিবে, তাহা এক প্রকার স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু প্রশাসনিকতার একমাত্র চালিকাশক্তি যদি নির্বাচনে জয়লাভ হয়, তবে সেই সরকারের প্রতি ভরসা বিচলিত হওয়া স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রী তাঁহার ভাষণে বলিয়াছেন, অতীত ভুলিয়া তাঁহারা মানুষকে বুঝাইবার চেষ্টা করিবেন। তবে, মানুষের কথা বুঝিবার প্রয়োজনটিও যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একই রকম গুরুত্বপূর্ণ, এই কথাটি তাঁহারা বুঝিবেন কি? নাগরিককে প্রজা ভাবিবার, তাহাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে তিলমাত্র গুরুত্ব না দিবার কু-অভ্যাসটি যত দ্রুত বর্জন করা যায়, ততই মঙ্গল।
অহেতুক জেদ এবং অগণতান্ত্রিকতার সাধনায় কেন্দ্রীয় সরকার যাহাকে বলি দিল, তাহার নাম সংস্কার। যে তিনটি কৃষি আইন শেষ অবধি প্রত্যাহার করিয়া লওয়া হইল, কৃষির স্বার্থে সেগুলির প্রয়োজন ছিল। ভারতীয় কৃষি দীর্ঘ দিন ধরিয়া যে অ-লাভজনক তলানিতে পড়িয়া আছে, বাজারের হাত ধরিয়াই সেই অতল হইতে নিষ্কৃতি মিলিত। এই আইনগুলি সেই পথই খুলিতে পারিত। কিন্তু, গণতন্ত্রে নাগরিকের উন্নতিসাধন করিতে হইলেও যে তাহা গায়ের জোরে করা চলে না, নাগরিকের সম্মতি আদায় করিয়া লইতে হয়, এই কথাটি প্রধানমন্ত্রী হয় বোঝেন নাই, অথবা বুঝিতে অস্বীকার করিয়াছেন। গণতন্ত্রের প্রতি তাঁহাদের অপরিসীম অশ্রদ্ধা এখন প্রধানমন্ত্রী-বর্ণিত সেই প্রদীপের শিখার ন্যায় প্রকট। ফলে, সংস্কারের প্রশ্নে রাজনৈতিক ঐকমত্য গঠনের প্রয়াস তাঁহারা করেন নাই। আইন বানাইবার পূর্বে মানুষকে সেই আইনের গুরুত্ব বুঝাইবার রাজনৈতিক অনুশীলনটিও সম্পূর্ণ গরহাজির ছিল। তাঁহারা জেদ করিয়াছিলেন— সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে দেশকে যথেচ্ছ চালনা করিবার জেদ। এমনকি, এক বৎসর ধরিয়া চলা আন্দোলনকেও তাঁহারা প্রাপ্য গুরুত্ব দেন নাই— বরং, দলের রাজনৈতিক ছক মানিয়া আন্দোলনকারীদের ‘দেশদ্রোহী’ সাব্যস্ত করিতে চাহিয়াছেন। দলীয় রাজনীতি আসিয়া প্রশাসনিকতাকে লইয়া গিয়াছে। তাহার ফল বিজেপির পক্ষে কতখানি ক্ষতিকারক হইল, সেই বিবেচনা তাহাদের নিজস্ব— কিন্তু, ভারতের ক্ষতি হইল বিস্তর। কৃষিক্ষেত্রে অতি জরুরি সংস্কার প্রক্রিয়াটি ঠেকিয়া গেল। এই ভুল হইতে তাঁহারা যদি ঠিক শিক্ষাটি লন, তবে সংস্কারের ইচ্ছাটিকে পঞ্চনদের জলে ভাসাইয়া দিবার পরিবর্তে তাঁহারা ভাবিবেন, কোন পথে চলিলে মানুষের সম্মতি অর্জনের মাধ্যমে সংস্কারগুলি সাধিত হইতে পারে। বিজেপির রাজনৈতিক লাভ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত মর্যাদা ইত্যাদির তুলনায় কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের গুরুত্ব যে অনেক বেশি, সরকার তাহা বুঝিলে মঙ্গল।