fusion

তিলে তিলে সাফল্য

ফিউশন অর্জনে অগ্রগতি তিলে তিলে আসিলেই বা মন্দ কী?

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৮:০১

পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান একদা এই প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন যে, কোনও প্রলয়ে মানবসভ্যতা বিলুপ্ত হইলে মাত্র একটি বাক্যে এই সভ্যতার কোন জ্ঞান পরবর্তী সভ্যতায় চালান করিলে কাজ চলিবে? তিনি নিজেই উত্তর দিয়া বলিয়াছিলেন যে, সব কিছুই পরমাণু দিয়া গঠিত, যে পরমাণুরা কিঞ্চিৎ দূরবর্তী হইলে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়, আবার পরস্পর নিষ্পেষিত হইতে চাহে না। ফাইনম্যানের মতে, ওই জ্ঞান পৃথিবীর প্রলয়ের পরে পর্যাপ্ত। তাঁহার কথা কত দূর সত্যি, তাহা ফিউশন প্রক্রিয়াতে ব্যস্ত গবেষকরা টের পাইতেছেন। ফিউশন হইল এমন এক বিক্রিয়া, যাহাতে একাধিক পরমাণু জুড়িয়া একটি ভারী পরমাণু সৃষ্টি করে। সাধারণত চারটি হাইড্রোজেন পরমাণু যুক্ত হইয়া একটি হিলিয়াম পরমাণু তৈরি হয়। ইহাতে কিঞ্চিৎ পরিমাণ পদার্থ হারাইয়া যায়। উক্ত পদার্থই আলবার্ট আইনস্টাইন আবিষ্কৃত ফর্মুলা অনুযায়ী প্রকাণ্ড এনার্জি রূপে দেখা দেয়। নক্ষত্রের অগ্নিকুণ্ডে এই ফিউশন প্রক্রিয়া সতত বিদ্যমান। আমাদের সূর্যেও উহা চলিতেছে। প্রত্যেকটি নক্ষত্রে চলে দুই বিপরীতমুখী বিক্রিয়া। বিপুল পরিমাণ পদার্থের অভিকর্ষজ চাপ, যাহা নক্ষত্রকে সঙ্কুচিত করিতে চায়। তাহার বিরুদ্ধে ক্রিয়া করে অগ্নিকুণ্ডের তাপ, যাহার বহির্মুখী চাপ নক্ষত্রকে ফুলাইয়া স্ফীত করিতে চায়। এক্ষণে এই কথা বলা দরকার যে, ফিউশন বিক্রিয়া অতীব শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমার মূল প্রক্রিয়া। নক্ষত্রের সহিত হাইড্রোজেন বোমার ফারাক এই যে, নক্ষত্রে ফিউশন বিক্রিয়া চলে তিলে তিলে, আর হাইড্রোজেন বোমায় প্রক্রিয়াটি চলে এক মুহূর্তে। অপেক্ষাকৃত কম বিধ্বংসী অ্যাটম বোমায় চলে যে প্রক্রিয়াটি, তাহার নাম ফিশন। উক্ত বিক্রিয়ায় ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম পরমাণু বিভাজিত হয়। ওই ফিশন বা বিভাজন প্রক্রিয়ায় কিঞ্চিৎ পরিমাণ পদার্থ হারাইয়া যায়। উক্ত পদার্থ আইনস্টাইন আবিষ্কৃত ফর্মুলা অনুসারে বিপুল পরিমাণ এনার্জি হিসাবে প্রতিভাত হয়। ওই এনার্জিই বোমার বিধ্বংসী ক্ষমতা। ফিশন তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়, ফিউশনে ছড়ায় না। সেই কারণে ফিশন পরমাণুচুল্লি হইতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করিলেও, ফিউশন প্রক্রিয়াটি পৃথিবীতে সম্পন্ন করিতে বিজ্ঞানীগণ উদ্গ্রীব। সেই উদ্দেশ্যে তাঁহারা বিগত কয়েক দশক ব্যাপী প্রচেষ্টা চালাইয়াছেন তথাকথিত ‘ক্লিন’ এনার্জি উৎপাদনে। সাবেক প্রথায় কয়লা বা তেল পুড়াইয়া বিদ্যুৎ উৎপাদন করিতে গ্রিনহাউস গ্যাসের কারণে পরিবেশ দূষিত হয়। পরমাণুচুল্লি হইতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়। বিবিধ বিপদ হইতে পরিত্রাণ পাইবার নিমিত্ত ফিউশন প্রক্রিয়ায় এনার্জি উৎপাদন ব্যতীত পৃথিবীর ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। দশকের পর দশক ধরিয়া বিজ্ঞানীগণের প্রয়াস সত্ত্বেও অদ্যাবধি যে ফিউশন প্রক্রিয়া অনায়ত্ত রহিয়া গিয়াছে তাহার কারণানুসন্ধানে ফাইনম্যানের মন্তব্য স্মর্তব্য। বিবিধ পরমাণু নিষ্পেষিত হইতে চাহে না। নক্ষত্রে প্রচণ্ড চাপ ও তাপে হাইড্রোজেন পরমাণুরা মিলিয়া হিলিয়াম পরমাণু তৈরি করে বটে, কিন্তু পৃথিবীর ল্যাবরেটরিতে নক্ষত্রের ন্যায় পরিস্থিতি তৈরি করা দুঃসাধ্য কর্ম।

১৯৮৯ সালে দুই বিজ্ঞানী আমেরিকার ইউটা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ববি স্ট্যানলি পনস এবং ইংল্যান্ডে সাদাম্পটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মার্টিন ফ্লেশম্যান রাতারাতি বিখ্যাত হইয়া উঠেন, তাঁহারা নাকি টেস্ট টিউবের মধ্যে ফিউশন প্রক্রিয়ার সন্ধান পাইয়াছেন। নক্ষত্রের ন্যায় চাপ ও তাপের ব্যাপার নাই, সাধারণ উষ্ণতায় ফিউশন দাবির জন্য তাঁহাদের ‘সাফল্য’ কোল্ড ফিউশন হিসাবে আখ্যা পায়। দাবি প্রতিষ্ঠায় দুই বিজ্ঞানী এতই উদ্গ্রীব যে, কোনও জার্নালে তাহা প্রকাশ না করিয়া সাংবাদিকদের সামনে ‘সাফল্য’ ঘোষণা করেন। পরে দেখা যায়, এই দাবি ভুয়া। কোল্ড ফিউশন বিজ্ঞান গবেষণায় কেলেঙ্কারিগুলির অন্যতম।

Advertisement

এই পরিপ্রেক্ষিতে ইংল্যান্ডে অক্সফোর্ডের নিকট জয়েন্ট ইউরোপিয়ান টরাস বা জেট ল্যাবরেটরির সাফল্য আশা জাগাইতেছে। ‘জেট’ গবেষকরা জানাইয়াছেন, তাঁহারা উক্ত যন্ত্রে লাগাতার এনার্জি উৎপাদনের ১৯৯৭ সালের রেকর্ডকে ভাঙিয়াছেন। তবে নক্ষত্রের ন্যায় চাপ এবং তাপ সৃষ্টি করিতে ল্যাবে যে পরিমাণ এনার্জি খরচ হয়, ফিউশন বিক্রিয়ায় পাওয়া যায় তাহা অপেক্ষা কম। বিনিয়োগ এবং উৎপাদনের অনুপাত লক্ষণীয়। জেট পরীক্ষাগারের ক্ষেত্রে ওই অনুপাত ০.৩৩। অর্থাৎ, এনার্জি বিনিয়োগ যদি ধরা হয় ১০০ শতাংশ, তাহাতে উৎপাদনের পরিমাণ মাত্র ৩৩ শতাংশ। তথাপি বিজ্ঞানীগণ উৎফুল্ল। ফিউশন অর্জনে অগ্রগতি তিলে তিলে আসিলেই বা মন্দ কী?

আরও পড়ুন
Advertisement