জনস্বার্থ মামলার ধারণাটি বিচারবিভাগের আদর্শ ভূমিকার সহিত সমঞ্জস কি না, তাহা লইয়া তর্ক আছে। তর্কের কারণও আছে। আইন অনুসারে সুবিচার করা এবং আইন সংবিধানসম্মত কি না তাহা যাচাই করা, এই দুইটিই আদালতের মৌলিক কর্তব্য। দ্বিতীয় কর্তব্যটি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এক্তিয়ারে, তবে গুরুতর মামলায় প্রথমটির ক্ষেত্রেও তাহার ভূমিকা অনস্বীকার্য— ‘শেষ বিচারের আদালত’ কথাটির সাধারণ অর্থ: অগতির গতি। জনস্বার্থ মামলার ক্ষেত্রে আদালতকে বৃহত্তর ভূমিকা স্বীকার করিতে হয়, বিচারবিভাগ তখন উপরোক্ত দুই মূল কর্তব্যের বাহিরে গিয়া জনসমাজ বা তাহার একটি অংশের সঙ্কট মোচন করিয়া মঙ্গল সাধনে ব্রতী হয়। অনেকের মতে জনস্বার্থ মামলার ধারণাটি অসঙ্গত, কারণ তাহা আদালতকে আপন ‘স্বাভাবিক’ ভূমিকার বাহিরে আনিয়া অন্য (অ)কাজে জড়াইয়া দেয়; বিচারবিভাগের কাজ দেশের সংবিধানের মাপকাঠিতে যথাযথ আইন এবং ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করা, ইহাতেই ‘জনস্বার্থ’ রক্ষায় আদালতের দায়িত্ব নির্দিষ্ট থাকা বিধেয়। গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামোয় বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে এক্তিয়ার বিভাজনের নির্ধারিত সীমারেখা লঙ্ঘিত হইলে শাসনতন্ত্রে যে বিকৃতি ঘটিতে পারে, তাহার বিবিধ নজির এই দেশেও দেখা গিয়াছে। জনস্বার্থ মামলার প্রকরণটিকে অপব্যবহার করিয়া আদালতকে প্রশাসনের কাজে ডাকিয়া আনিবার প্রয়াস বিরল নহে, বিরল নহে অবান্তর বা তুচ্ছ কারণে আদালতের সময় নষ্ট করিবার অপচেষ্টাও।
কিন্তু আদর্শ অবস্থা হইতে বাস্তব পরিস্থিতির দূরত্ব যখন বিস্তর, তখন কর্তব্য বিভাজনের বিধি অতিক্রমের প্রয়োজনও অস্বীকার করা যায় না। প্রশাসন যদি তাহার কর্তব্য না করে, কর্তব্য লঙ্ঘনই যদি তাহার অভ্যাসে দাঁড়ায় এবং তাহার পরিণামে যদি গণতন্ত্র ও সংবিধানের ভিত্তিমূলে আঘাত লাগে, তখন আদালতকে, বিশেষত সর্বোচ্চ আদালতকে ‘অগতির গতি’ হইয়া উঠিতেই হয়। সেই ক্ষেত্রে জনস্বার্থের মামলা দেশ ও সমাজকে রক্ষা করিবার প্রকরণ বলিয়া গণ্য হইতে পারে। ভারতে তাহার নমুনা ক্রমাগতই প্রকট হইতেছে। যেমন সম্প্রতি হরিদ্বারে তথাকথিত ধর্ম সংসদ হইতে কিছু তথাকথিত সাধুসন্ত ও সংশ্লিষ্ট লোকজনের উৎকট সাম্প্রদায়িক প্রচার এবং দিল্লিতে হিন্দু যুব বাহিনী নামক শিবিরের অনুরূপ বিদ্বেষ-উদ্গারের পরেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কার্যত নিশ্চল— এই পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টে যে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হইয়াছে, ভারত নামক ধারণাটির স্বার্থেই তাহার গুরুত্ব অপরিসীম। লক্ষণীয়, গত সোমবার সর্বোচ্চ আদালত সেই গুরুত্ব স্পষ্টত স্বীকার করিয়াছে এবং এই মামলাকে অগ্রাধিকার দিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছে। এই তৎপরতা ভারতীয় গণতন্ত্রকে ভরসা দেয়।
লক্ষণীয় একই দিনে সুপ্রিম কোর্টের গৃহীত আর একটি সিদ্ধান্তও। পঞ্জাবে প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচিতে বাধা পড়িবার ঘটনা সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকার ‘অতি-তৎপর’ হইয়া হস্তক্ষেপের চেষ্টা চালাইতেছিল, নিজেরাই তদন্তের ভার লইয়া রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের আধিকারিকদের জিজ্ঞাসাবাদ, এমনকি কৈফিয়ত তলব অবধি শুরু করিয়া দিয়াছিল। আপাতত আদালত কেন্দ্রীয় সরকারকে এই বিষয়ে তদন্ত বন্ধ করিবার নির্দেশ দিয়াছে, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিচ্যুতির অভিযোগ যাচাই করিবার ভার দিয়াছে এক ভূতপূর্ব বিচারপতিকে। স্পষ্টতই, এই ক্ষেত্রে কেন্দ্র এবং রাজ্যের এক্তিয়ারের সীমারেখাটিকে মান্য করিয়া শাসনতন্ত্রের ধর্ম বজায় রাখিবার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য পূরণেই সর্বোচ্চ আদালত সক্রিয়। শাসনের ভার যাঁহাদের হাতে, তাঁহারা দুঃশাসনে প্রমত্ত বলিয়াই বিচারবিভাগের ভূমিকা এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। সেই প্রেক্ষাপটে সুপ্রিম কোর্টের এই বহুমুখী তৎপরতাই এখন ভারতীয় গণতন্ত্রের বড় ভরসা।