চতুর শব্দটির আদি অর্থ: কার্যদক্ষ, পটু তথা কুশলী। আপন বুদ্ধিকে কাজে লাগাইয়া যে কার্যসিদ্ধি করিতে পারে, সে বড় চতুর। উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিতে বুদ্ধির ব্যবহারে দোষের কিছু নাই। তবে কিনা, উদ্দেশ্যটি যদি শুভ না হয়, বিশেষত ফাঁকির দ্বারা কার্যসিদ্ধি করিয়া নাম (এবং ভোট) কিনিবার মতলব যদি বুদ্ধি ও কুশলতার চালিকাশক্তি হইয়া উঠে, তাহা হইলে চতুরতার কলঙ্কই প্রকট হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বিদ্যাঞ্জলি’ প্রকল্পের অবয়বে সেই কলঙ্কের ছাপ সুস্পষ্ট। এই প্রকল্পের লক্ষ্য: সরকারি স্কুলের ঘাটতি পূরণে নাগরিকদের আর্থিক সহযোগিতা ও স্বেচ্ছাসেবা। স্বেচ্ছাসেবীরা ছাত্রছাত্রীদের পড়াইবেন, বইপত্র আদি শিক্ষার বিবিধ প্রকরণ, স্কুলের পরিকাঠামো ও অন্যান্য প্রয়োজন মিটাইতে সমাজ অনুদান দিবে। স্কুল শিক্ষার সহিত যুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এই উদ্যোগকে সাফল্যমণ্ডিত করিয়া তুলিবার সরকারি বার্তা চলিয়া গিয়াছে, হয়তো অচিরেই জনপরিসরের বিবিধ অঞ্চলে প্রধানমন্ত্রীর উজ্জ্বল মুখমণ্ডল দেশবাসীকে বুঝাইবে যে, সর্বশিক্ষা কেবল ‘সকলের শিক্ষা এবং সকলের জন্য শিক্ষা’ নহে, তাহার প্রকৃত অর্থ: সকলের দ্বারা শিক্ষা।
সাফ সাফ বলিলে, কেন্দ্রীয় সরকারের এই উদ্যোগটি ফাঁকি দিয়া কার্যসিদ্ধির এক চতুর প্রয়াস। শিক্ষার প্রসারে নাগরিক সমাজের স্বেচ্ছাব্রত অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত, বাস্তব পরিস্থিতিতে জরুরিও বটে। অতিমারির প্রকোপে অন্য নানাবিধ সঙ্কটের মতোই শিক্ষা-সঙ্কটও বিপুল আকার ধারণ করিয়াছে। তাহার মোকাবিলায় দেশ জুড়িয়াই বহু সামাজিক উদ্যোগ দেখা যাইতেছে, পশ্চিমবঙ্গও ব্যতিক্রম নহে। এই সব প্রয়াস আরও অনেক বেশি কার্যকর হওয়া আবশ্যক। কিন্তু সরকার আপন দায় তাহার উপর ছাড়িয়া দিতে পারে না। শিক্ষার, বিশেষত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এ দেশে সেই দায়িত্ব রাষ্ট্র যথেষ্ট পালন করে নাই। মোদী জমানায় শিক্ষা বরাদ্দ বাড়িবার বদলে বরাদ্দের ঘাটতি বাড়িয়াছে। অতিমারির কালে যখন রাষ্ট্রের সর্বশক্তি দিয়া ঘাটতি পূরণে বাড়তি উদ্যোগ করিবার কথা ছিল, তখনও তাঁহারা হাত ধুইয়া ফেলিতে ব্যস্ত। ডিজিটাল শিক্ষা ভারতের মতো দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীর নিকট দুর্লভ জানিয়াও তাঁহারা সেই শিক্ষার গুণকীর্তনে ব্যস্ত। ইহা কেবল বঞ্চনা নহে, প্রবঞ্চনাও।
এই প্রেক্ষাপটেই ‘বিদ্যাঞ্জলি’কে প্রবঞ্চনার নূতন কৌশল বলিয়া মনে করিবার বিলক্ষণ কারণ আছে। দেশের সরকারি স্কুলগুলিতে আক্ষরিক অর্থে লক্ষ লক্ষ শিক্ষকের পদ শূন্য, পঠনপাঠনের পর্যাপ্ত বন্দোবস্ত আছে সিকিভাগেরও কম স্কুলে। কেন্দ্র এবং রাজ্য, উভয় স্তরেই শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো এই কারণে অত্যাবশ্যক। কেন্দ্রের সামর্থ্য রাজ্যের তুলনায় অনেক বেশি, সুতরাং দায়ভাগও তাহারই বেশি হওয়া উচিত। প্রয়োজনে রাজ্যগুলিকে এই প্রয়োজন মিটাইতে বিশেষ অনুদান বা অন্যবিধ সাহায্য করা কেন্দ্রের কর্তব্য। অথচ শাসকরা এখন সেই বোঝা জনসাধারণের উপর চাপাইয়া দিতে তৎপর। প্রশ্ন কেবল অর্থের নহে। সরকারি বা সরকার পোষিত স্কুলে সমস্ত ছাত্রছাত্রীর স্বাভাবিক অধিকারসাম্যের বোধ তৈয়ারি হয়, অন্য ধরনের ব্যবস্থায় নানা ভাবে তাহার অভাব ঘটিতে পারে। প্রথমত, সেখানে কেহ কেহ বেশি সমান বলিয়া গণ্য হয়। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের প্রতি দাক্ষিণ্যের ধারণা দানা বাঁধিতে পারে। আবার, স্বেচ্ছাসেবার ভেক ধরিয়া বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী শিক্ষার ভুবনে আপন প্রভাব বিস্তার করিতে পারে, বর্তমান শাসকদের জমানায় তেমন আশঙ্কা দ্বিগুণ বলিলে কম বলা হয়। শিক্ষার ঘাটতি যদি তাঁহারা সত্যই পূরণ করিতে চাহেন তবে একটি কথা স্মরণে রাখিতেই হইবে— সমাজকে দায়িত্ব বুঝাইবার আগে নিজেদের দায়িত্ব পালন না করিলে চলিবে না।