নাগাল্যান্ডের ঘটনা সমগ্র দেশকে নাড়াইয়া দিয়াছে। স্বাভাবিক। গত এক দশকের মধ্যে এত বড় নৃশংস কাণ্ড এই অঞ্চলে ঘটে নাই। বিনা প্ররোচনায় সেনা কম্যান্ডোর গুলি সাধারণ গ্রামবাসীদের বুক ফুঁড়িয়া দিলে যে প্রবল আতঙ্ক উপস্থিত হইবার কথা, দশকাধিক কালের পর উত্তর-পূর্ব ভারত আবার সেই মহাতঙ্কে গ্রস্ত হইয়াছে। ঘটনার যে ব্যাখ্যাই এখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা সেনা কর্তৃপক্ষ দিন না কেন, এই একটি ঘটনার ফলে যে উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রতিবাদীদের প্রতিবাদ আরও কঠিন হইয়া উঠিবে, নাগরিকরা আরও বেশি করিয়া নিজেদের নিরাপত্তাহীন এবং অবহেলিত মনে করিবেন, সশস্ত্র বাহিনীর বিপরীতে সমাজ অসহায় ও ত্রস্ত হইয়া রাষ্ট্রবিরোধিতায় আত্মনিয়োগ করিবে— সে সম্ভাবনা অনেক গুণ বাড়িয়া গেল। এই ভয়ঙ্কর দুষ্কার্যের ব্যাখ্যা দিবার পরিবর্তে ভাবিয়া দেখা উচিত ছিল যে, সরকার ও সেনাবাহিনী কী করিতে চাহেন, এবং শেষাবধি কী করিলেন। ‘ভুল’ হইয়াছে তো বটেই, ভাবা উচিত সেই ভুল কেন ঘটিল। কোনও কোনও মুহূর্ত আসে যখন কৃতকর্মের বিশ্লেষণ না করিয়া তাহার জন্য লজ্জা বোধ এবং ক্ষমা প্রার্থনাই শ্রেয়। তবে ভারতীয় রাষ্ট্রের সেই স্বাভাবিক বোধ কম, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের আমলে তো তাহা বিশেষ ভাবেই কম। সেনাবাহিনীর কোনও কাজে ভুল স্বীকার করিবার মধ্যে যেন এক বিরাট অমর্যাদা আছে— ভাবটি এমনই। অথচ, সোজা কথা ইহাই, দমনের রাস্তা খোলা থাকিলে দমনের দৃষ্টান্তও বাড়িতে থাকে। ভারতের দুইটি প্রান্তে একই ছবি: অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেনাবাহিনীকে যথেচ্ছ ক্ষমতা দান, এবং তাহার পর সেই যদৃচ্ছশাসনের জন্য ত্রুটিস্বীকারে অনীহা, আত্মপক্ষ-সমর্থন, কিংবা নেহাত ‘খেদ’ প্রকাশ। এমতাবস্থায় যাহা ঘটিবার কথা তাহাই ঘটিতেছে— যুগপৎ কাশ্মীর ও উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগরিক সমাজ ক্রমশই আরও বেশি করিয়া চরমপন্থার দিকে সরিতেছে। এমনটাই চলিতে থাকিলে দমনমূলক আইনের প্রয়োজন ক্রমশ আরও বেশি পড়িবে— যদি না এখনই দমনমূলক আইনের প্রয়োজন এবং প্রয়োগ লইয়া একেবারে গোড়ার স্তরে পুনর্বিবেচনা শুরু করা হয়।
দুইটি বিষয় জরুরি। প্রথমত, নির্বিচারে গুলি চালাইবার মধ্যে একটি ভয়াবহ অতিরেক আছে— নিজেরই দেশের নাগরিকের ক্ষেত্রে যে অতিরেক ঘটিবার কথা নহে। যে ভাবে জঙ্গি দমন করা হয়, সেই একই পদ্ধতি কিংবা হিসাব অনুযায়ী সিভিলিয়ান সমাজের উপর গুলিবর্ষণ করা যায় না। বহু দেশে অসামরিক নাগরিক সম্মুখে থাকিলে গুলি চালাইবার ক্ষেত্রে নিষেধ থাকে, অন্তত বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়। বারংবার এমন অতিরেকের ঘটনা বুঝাইয়া দেয় যে, ভারতীয় সেনার ক্ষেত্রে সেই নির্দেশবিধিটি স্পষ্ট নহে। তাহা স্পষ্ট করিবার দায় কিন্তু সেনাবাহিনীর, রাষ্ট্রেরও। বহু অন্যায় ঘটিয়াছে, আর নহে। নতুবা বহিঃশত্রুর সহিত অভ্যন্তরীণ শত্রুরও লক্ষ্য হইয়া এ দেশ আতঙ্কসাগরে ডুবিবে। দ্বিতীয়ত, গোয়েন্দা ব্যর্থতা বা ইনটেলিজেন্স অদক্ষতা। কোথায় কত দূর হামলার ভয়, কাহাদের ঠেকাইতে হইবে, এই সব গোয়েন্দা তথ্য আহরণে ভ্রান্তির সাক্ষাৎ ইশারা এই সব ঘটনায়। এক দিকে কাশ্মীরের মতো জায়গায় জঙ্গি হানায় পুলিশের নিধন, অন্য দিকে কাশ্মীর ও উত্তর-পূর্বে সেনার হাতে নাগরিক নিধন— গোয়েন্দা কর্মকাণ্ডে অপারদর্শিতা ও ব্যর্থতা বারংবার প্রকাশিত। ইহা ছেলেখেলার বিষয় নহে। ইনটেলিজেন্স তথ্যের সহিত দেশবাসীর প্রাণের প্রশ্ন জড়িত। সুতরাং—প্রশ্ন অনেক। আফস্পা-র মতো ভয়ঙ্কর দমনমূলক আইনে সেনার হাতে একনাগাড়ে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়া রাখা কি সফল স্ট্র্যাটেজি? নিরাপত্তার কাজে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষকদের বদলে সেনাবাহিনীর উপর দায়িত্ব অর্পণ কি আদৌ জরুরি? বিরোধীদের এই সব প্রশ্ন তুলিবার কথা। এবং সরকারের গুরুত্ব দিয়া বিষয়গুলি ভাবিবার কথা।