সম্মেলনের শুরুতেও ভারত, শেষেও। গ্লাসগোয় ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি)-র ২৬তম কনফারেন্স অব পার্টিজ় (সংক্ষেপে, সিওপি ২৬)-এর গোড়ায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ভারতের দায়বদ্ধতার কথা বলিয়া সম্মেলনের সুর বাঁধিয়া দিয়াছিলেন। সম্মেলনের শেষে পরিবেশমন্ত্রীর নেতৃত্বে ভারতীয় প্রতিনিধি দলই সেই সুরটি কাটিল— গ্লাসগোর ঘোষণাপত্র হইতে কয়লার ব্যবহার বন্ধ করিবার প্রস্তাবটি সরাইতে বাধ্য করিল ভারত। ‘ফেজ় আউট’ কথাটির পরিবর্তে ব্যবহৃত হইল ‘ফেজ় ডাউন’। জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত পরিবেশ কূটনীতি, আর্থিক উন্নয়ন বা ইতিহাস— এই বিষয়গুলির মধ্যে কোনওটি সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা থাকিলেই প্রধানমন্ত্রী বুঝিতেন, গোড়ায় তিনিই সুরটি ভুল তারে বাঁধিয়াছিলেন। ২০৭০ সালের মধ্যে ভারত কার্বন নিঃসরণের নেট পরিমাণ শূন্যে নামাইয়া আনিতে পারিবে কি না, তাহা দীর্ঘমেয়াদি তর্ক— কিন্তু, জলবায়ু পরিবর্তন-রোধে ভারতের পক্ষে কতখানি করা সম্ভব, এবং কতখানি করা উচিত, সেই কথা মাথায় রাখিলে বিশ্বমঞ্চে কোনও বড় প্রতিশ্রুতি না দেওয়াই বিধেয় ছিল। ভারতে এখনও শক্তির প্রধানতম উৎস কয়লা— অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতিটি পাল্টাইবে, তেমন আশা ক্ষীণ। তাহার জন্য পরিকাঠামো খাতে যে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন, তাহা ভারতের সাধ্যাতীত। কাজেই, কয়লা ব্যবহারের অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখাই ভারতের স্বার্থের অনুকূল। শেষ অবধি ভারত সেই কাজটিই করিয়াছে। জলবায়ু পরিবর্তন-রোধে ভারত নিজের দায়িত্ব অবশ্যই পালন করিবে, কিন্তু উন্নয়নের অধিকার বিসর্জন দিয়া নহে।
এখানেই ইতিহাসের গুরুত্ব— শিল্পায়নের ইতিহাস; পরিবেশ কূটনীতির ইতিহাসও বটে। শিল্পোন্নত দেশগুলি তাহাদের আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জন করিয়াছিল বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করিয়াই— শিল্প বিপ্লবের ইতিহাস কয়লার কৃষ্ণাক্ষরেই লেখা। ফলে, বিশ্ব উষ্ণায়নের ঐতিহাসিক দায় তাহাদের ঢের বেশি। অন্য দিকে, দুনিয়ার মোট কার্বন নিঃসরণের পরিমাণে দেশগত সমতা বজায় রাখিতে হইলেও এখন কয়লা পুড়াইবার অধিকার উন্নয়নশীল দেশগুলিরই আছে। পরিবেশ কূটনীতির আলোচনা প্রথমাবধি এই ঐতিহাসিক দায়িত্বের কথা স্মরণে রাখিয়াছিল। জ্বালানি হিসাবে কয়লাই সর্বাপেক্ষা সস্তা। উন্নয়নশীল দেশগুলির পরিকাঠামোও কয়লার জন্যই প্রস্তুত। ফলে, উন্নয়নশীল দুনিয়ার উন্নয়নের অধিকার স্বীকার করিতে হইলে এখনই তাহাদের কয়লা হইতে সরিয়া আসিতে বাধ্য করা চলে না। ভারত শেষ পর্যন্ত এই অবস্থানটি বজায় রাখিতে পারিয়াছে, তাহা প্রতিনিধি দলের কৃতিত্ব। তবে, একই সঙ্গে এই কথাটিও ভুলিলে চলিবে না যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ বিপদের সম্মুখীন ভারত। ফলে, আর্থিক উন্নয়ন ও পরিবেশের স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখিবার কাজটি ভারতকে করিতে হইবে।
একটি প্রশ্ন থাকিয়াই যায়। ভারত প্রভূত পরিমাণে কয়লা ব্যবহার করে ঠিকই, কিন্তু আন্তর্জাতিক স্তরে তুলনা করিলে চিনের নিকট তাহা অকিঞ্চিৎকর। চিন দুনিয়ার বৃহত্তম কয়লা উৎপাদক ও ব্যবহারকারী। ফলে, কয়লা ব্যবহারের অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখিবার তাগিদটি তাহাদেরই সর্বাধিক হইবার কথা। এক্ষণে ভারতের কূটনৈতিক কর্তব্য ছিল দুই পা পিছাইয়া আসিয়া চিনকে এই প্রশ্নে নেতৃত্ব দিতে দেওয়া। কয়লা ব্যবহার অব্যাহত রাখিবার দাবিটির গায়ে যে কালিমা লাগিয়া আছে, তাহা হাতে না মাখিলেও ভারতের চলিত। পরিবেশ কূটনীতির মঞ্চে এই ধরনের ব্যর্থতা পরবর্তী কালে বিপুল গুনাগার আদায় করিতে পারে। কয়লা ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি অব্যাহত রাখিবার ঐতিহাসিক দায়টি ভারত স্বেচ্ছায় মাথা পাতিয়া লইল, ইহা দুর্ভাগ্যের কথা।