Russia Ukraine War

তাহাদের কথা

এই যুদ্ধ ক্রমশ তাঁহাদের দৈনন্দিন জীবন পাল্টাইয়া দিবে, পূর্বেকার স্বাভাবিক দিনযাপনে ফিরিবার রাস্তাটি সহজ হইবে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২২ ০৫:৩৩

ছাড়িবার পূর্বে শেষ বারের মতো গির্জার সম্মুখে অবনত ক্রন্দনরত বৃদ্ধ— ইউক্রেনীয় শহর ইরপিনের এই চিত্র বিশ্ববাসীকে আন্দোলিত করিয়াছে। এবং, এক চিরন্তন সত্য স্মরণ করাইয়া দিয়াছে: যুদ্ধে তাঁহাদেরই সর্বাপেক্ষা ক্ষতি, যাঁহারা যুদ্ধের সহিত সম্পর্করহিত। যুদ্ধ বাধিতেই তাঁহারা মারা পড়িতেছেন, রাষ্ট্রনেতাদের কায়েমি স্বার্থের সহিত যাঁহাদের দৈনন্দিন চাওয়া-পাওয়া দূরদূরান্তেও মিলিবে না। অদ্যাবধি ইউক্রেনে যে দুইশত দুইটি বিদ্যালয়, চুয়ান্নটি হাসপাতাল, দেড় হাজার বাসস্থান ধ্বংস হইয়াছে, যে হাজারখানেক জনপদ জল ও বিদ্যুৎশূন্য হইয়াছে, তাহাদের সহিত ক্রেমলিন বা নেটোর নিরাপত্তার সরাসরি সম্বন্ধ আছে কি? বিপ্রতীপে, রুশ রাষ্ট্রের এই বাহুবল লইয়াই বা দেশের নাগরিকেরা কী করিবেন? তাঁহারা যুদ্ধের ভয়ানক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিণতি টের পাইতেছেন, কেহ দেশ ছাড়িয়া পালাইতেছেন, কেহ দেশের মাটিতেই প্রতিবাদে নামিয়াছেন। তাঁহারা বুঝিতেছেন যে, এই যুদ্ধ ক্রমশ তাঁহাদের দৈনন্দিন জীবন পাল্টাইয়া দিবে, পূর্বেকার স্বাভাবিক দিনযাপনে ফিরিবার রাস্তাটি সহজ হইবে না।

এই ধ্বনির অনুরণন শুনা গিয়াছে কলিকাতা পুস্তক মেলায় আগত মস্কোর সাংস্কৃতিক দূত আনা মোরেভার কথাতেও। ইউক্রেনীয় বন্ধুদের নিকট ক্ষমা চাহিবার লজ্জার কথা ব্যক্ত করিয়াছেন তিনি। জানাইয়াছেন, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে নিরীহ মানুষের যে প্রাণহানি ও সম্পত্তিক্ষয় হইতেছে, সেই বীভৎস অসহায়তার তুল্য কোনও অনুভূতি হয় না। ভারতবাসীকে তিনি দেশভাগের কথা স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন। এই ভূমির বাসিন্দারাও রাতারাতি দুই ভিন্ন দেশের নাগরিক হইয়া গিয়াছিলেন। অদৃষ্টপূর্ব সংঘর্ষ ও লোকক্ষয় দেখিয়াছিলেন, জানিয়াছিলেন কাহাকে বলে উদ্বাস্তুস্রোত। তাহাও ছিল রাজনৈতিক ক্ষুদ্রস্বার্থের হিসাবনিকাশ, যাহার ফলে শতসহস্র জনতার জীবনের বাস্তব অনপনেয় রূপে বদলাইয়া গিয়াছিল। রুশ-ইউক্রেন হাজার বৎসরের যৌথ সংস্কৃতিও আজ এমনই রাজনৈতিক সম্মুখসমরে— অতএব এই তুলনাটি স্বাভাবিক। দুর্ভাগ্যের কথা, জনজীবনের এই যৌথতা কোন খাতে বহিবে, তাহা প্রধানত রাজনীতিই নির্ধারণ করিয়া দিবে, জনতা ক্রীড়নকের ন্যায় উহা পালন করিবে। আনা মোরেভা-সহ অজস্র রুশবাসী কেবল সঙ্কুচিত হইয়া দিন কাটাইতে পারেন, উহার অধিক কিছু নহে।

Advertisement

বস্তুত, যুদ্ধের সহিত জনতার মনোবলের প্রশ্নটিও গভীর ভাবে জড়িত। বিশেষত আক্রমণকারী দেশের মানুষ অধিকাংশ সময়েই মরমে মরিয়া থাকেন, এক অপরাধবোধের ভার তাঁহাদের বহন করিতে হয়, যাহাতে তাঁহাদের কোনও হাতও নাই। স্মরণে থাকিবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভয়াবহ আক্রমণগুলির যাথার্থ্য নির্মাণে কী ভাবে সক্রিয় হইয়া উঠিত নাৎসি জার্মানির প্রচারযন্ত্র। যে দেশ প্রতিবেশীদের উপর বোমা ফেলে, এবং ক্রমশ অবশিষ্ট বিশ্ব হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে, তাহার নাগরিকদের দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া স্বাভাবিক। যুদ্ধ চালাইতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে উহা চাপা দিতে হয়। ইহা আসলে মনুষ্যত্ব ও রাজনীতির মুখামুখি দাঁড়াইবার সময়, যাহা জনতা ও রাষ্ট্রের টানাপড়েনে মূর্ত হইয়া উঠে। এক্ষণে তাহাই ধরা পড়িতেছে আনা মোরেভার কথায়, অসংখ্য রুশবাসীর নানা প্রকার কার্যকলাপে।

আরও পড়ুন
Advertisement