বিবিধ সমীক্ষা বারে বারেই জানাইতেছে যে, দুনিয়া যে তালে, যে ছন্দে চলিতেছে, তাহাতে বিশ্ব উষ্ণায়নের বিপদ হইতে নিস্তার পাইবার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। কোন দেশের সরকার জলবায়ু সম্মেলনে আসিয়া কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কতখানি কমাইবার প্রতিশ্রুতি দিল, প্রকৃত প্রস্তাবে তাহা অর্থহীন— শেষ অবধি নিঃসরণ কতখানি কমানো সম্ভব হইল, মূল প্রশ্ন তাহাই। এক্ষণে বিভিন্ন সরকার হাত উল্টাইয়া বলিবে, মানুষ যদি সচেতন না হয়, তাহা হইলে সরকারের কী বা করিবার থাকিতে পারে। কথাটি যে মিথ্যা, তাহা নহে। শিল্পক্ষেত্র বিপুল দূষণ ঘটাইয়া থাকে, তাহা অনস্বীকার্য; কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়নের পিছনে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ভূমিকাও যথেষ্ট। যথেচ্ছ গাড়ি ব্যবহার করাই হউক, খাদ্যাভ্যাসই হউক বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র ব্যবহার— প্রাত্যহিকতায় কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বিপুল। স্মরণ করাইয়া দেওয়া বিধেয় যে, তাহাতে দরিদ্র মানুষের অবদান সামান্যই— দূষণের জন্য দায়ী মূলত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাই। এবং, বহু সমীক্ষায় ধরা পড়িতেছে যে, এই অর্থবান শ্রেণির কার্বন পদচিহ্ন গোটা দুনিয়াতেই কম-বেশি সমান। অর্থাৎ, সামলাইতে হইলে এই শ্রেণির দিকে নজর দেওয়াই বিধেয়।
জীবনযাত্রায় পরিবর্তন সাধনের কাজটি অবশ্য ভয়ঙ্কর কঠিন। তাহার একাধিক কারণ। প্রথমত, মানুষ অভ্যাসের দাস। ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়িয়া যাতায়াত যাঁহাদের অভ্যাস, তাঁহাদের বাসে-ট্রামে চাপিতে বলিলে প্রতিরোধ স্বাভাবিক। এক হয়, যদি দেশের সরকার আইন করিয়া গাড়ি ব্যবহার বন্ধ করিয়া দেয়, অথবা বাতানুকূল যন্ত্রকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে, ব্যক্তিগত অধিকারে অতখানি হস্তক্ষেপ স্তালিনের রাশিয়ায় হইলেও হইতে পারিত, সভ্য জগতে সেই পরামর্শ বর্জনীয়। পরিবেশের কথা ভাবিয়া অভ্যাস পাল্টাইবার পথে দ্বিতীয় বাধা হইল, তাহার ‘ফিডব্যাক’ নাই— অর্থাৎ, কেহ কার্বন ফুটপ্রিন্ট দেখিয়া খরিদ্দারি করিলেও তাঁহার তৎক্ষণাৎ টের পাইবার জো নাই যে, তাঁহার কৃচ্ছ্রসাধনের ফলে পরিবেশের কী উপকার হইল। একই সঙ্গে দুধপুকুরের গল্পটিও প্রযোজ্য— এক জন সচেতন হইয়া নিজের জীবনযাত্রায় কাটছাঁট করিলেই বা কী; অন্যরা যদি না পাল্টান, তবে সেই এক জনের ত্যাগস্বীকার জলে যাইবে। বিজ্ঞানচেতনা বাড়াইলে দীর্ঘমেয়াদে লাভ হইবে না, এমন কথা বলা ধৃষ্টতা হইবে— কিন্তু কেন্স বলিয়াই রাখিয়াছেন, দীর্ঘমেয়াদে আমরা সকলেই মৃত।
তবে উপায় কী? আচরণবাদী অর্থশাস্ত্র বলিবে, উপায়টির নাম ‘নাজ’— মানুষকে কাম্য আচরণের দিকে আলতো ঠেলিয়া দেওয়া। সিঙ্গাপুরে গণপরিবহণ ব্যবহার করিলে ‘বোনাস পয়েন্ট’ মিলিতেছে, পরে যাহা নগদে বা অন্য কোনও সুবিধায় রূপান্তরিত করিয়া লওয়া যায়। অফিসে প্রাকৃতিক আলো ব্যবহার করিলে করে ছাড় দিবার ব্যবস্থা হইতে পারে। বাড়িতে বাতানুকূল যন্ত্র বসাইলে সম্পত্তি করের পরিমাণ বাড়াইবার ব্যবস্থাও করা সম্ভব। দোকান-বাজারে স্থানীয় পণ্য— অর্থাৎ যাহার কার্বন ফুটপ্রিন্ট ছোট— নজরে পড়িবার মতো জায়গায় রাখিবার নীতি গ্রহণ করা যাইতে পারে। কানাডায় একটি সমীক্ষায় অফিস বাড়ির লিফটে দরজা আটকাইবার সময়টি ১৭ সেকেন্ড বাড়াইয়া দেওয়ায় লিফট ব্যবহারের প্রবণতা কমিয়াছিল। অর্থাৎ, অভ্যাস পাল্টাইবার পথ আছে। সরকার সেই পথে হাঁটিবে কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন।