Mahua Moitra

প্রতিহিংসা

মহুয়া মৈত্রের সাংসদ পদ খারিজের সিদ্ধান্তটিকে বিরোধীরা প্রতিহিংসার রাজনীতি বলছেন। অনতি অতীতেই রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজের সিদ্ধান্তটির কথাও ভুললে চলবে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:৪৫
mahua moitra

মহুয়া মৈত্র। —ফাইল চিত্র।

জাতীয় সুরক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সে কথা মহুয়া মৈত্রও মানবেন, নিশিকান্ত দুবেও। শ্রীদুবে লোকসভার স্পিকারের কাছে অভিযোগ করেছিলেন যে, মহুয়া মৈত্র টাকার বিনিময়ে সংসদে প্রশ্ন করেন। সেই অভিযোগ ও তার ‘তদন্ত’-র পথ বেয়ে শেষ অবধি জানা গেল যে, তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ তাঁর লোকসভার ওয়েবসাইটে লগ ইন করার আইডি এবং পাসওয়ার্ড জানিয়েছিলেন তাঁর এক ব্যক্তিগত বন্ধুকে। অপরাধ, তাতে সন্দেহ নেই। লোকসভার এথিক্স কমিটি জানিয়েছে, এর ফলে জাতীয় সুরক্ষা বিঘ্নিত হয়েছে। অতএব, মহুয়া মৈত্রের শাস্তি হল— তিনি লোকসভা থেকে বহিষ্কৃত হলেন। ‘ব্যক্তিগত বন্ধু’কে আর কেউ আইডি-পাসওয়ার্ড জানান কি না, তা জানা না গেলেও এই পর্বে উঠে এল একটি তথ্য— অনেক সাংসদই তাঁর ব্যক্তিগত সহায়কদের এই ‘লগ ইন ক্রেডেনশিয়াল’ জানিয়ে থাকেন। লোকসভায় প্রশ্ন জমা দেওয়া, ইমেল দেখা অথবা পরিবহণ ভাতা দাবি করার কাজগুলি সেই সহায়করাই করেন। শ্রীমৈত্র এই ফাঁকটিরই দোহাই দিয়েছিলেন। গত নভেম্বরে কেন্দ্রীয় সরকার এই ব্যবস্থাটি বন্ধ করেছে। জানানো হয়েছে, অতঃপর সাংসদরা আর কাউকেই এই তথ্য দিতে পারবেন না, লোকসভার ওয়েবসাইটে লগ ইন করার ব্যবস্থাটি শুধুমাত্র সাংসদদের জন্যই। বলা যেতে পারত যে, গোটা সমস্যাটির সুষ্ঠু সমাধান হয়েছে— অভিযুক্ত সাংসদের শাস্তি হয়েছে, এবং অন্যায়ের পথটিও বন্ধ করা হয়েছে। যে কোনও সভ্য ব্যবস্থায় যা হয়, ভারতীয় সংসদেও তাই হয়েছে।

Advertisement

কিন্তু, সে কথাটি বলার উপায় নেই। তার প্রথম এবং প্রধান কারণ, মহুয়া মৈত্রের যে শাস্তি হল, তা গুরু পাপে অতি গুরুতর দণ্ড। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হিসাবে তাঁকে একটি অধিবেশনের জন্য বহিষ্কার করা যেত, হয়তো জরিমানাও করা যেত। সংশয় হয়, তাঁকে শায়েস্তা করার জন্য একটি অছিলার প্রয়োজন ছিল, এবং সেই প্রয়োজন মেটাতেই গোটা চিত্রনাট্য রচিত হল। তাঁর বিরুদ্ধে গোড়ায় যে অভিযোগ উঠেছিল— অর্থাৎ, টাকা নিয়ে লোকসভায় প্রশ্ন উত্থাপন করা, যা সাংসদের অধিকারভঙ্গের পর্যায়ভুক্ত— তার প্রমাণ মেলেনি। প্রমাণ করার খুব যে চেষ্টা হয়েছে, সে কথাও বলা মুশকিল। দ্বিতীয়ত, জাতীয় সুরক্ষা এবং সংহতির পক্ষে আরও অনেক বেশি ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক কাজ করেও অনেকেই পার পেয়ে যান। সাম্প্রতিকতম উদাহরণ বিজেপির রমেশ বিধুরি। বিএসপি-র দানিশ আলি সম্বন্ধে তিনি যে মন্তব্যটি করেছিলেন, তার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেই তাঁর দায় মিটেছে। এমন উদাহরণের তালিকা করা নিষ্প্রয়োজন। মহুয়া মৈত্র ও রমেশ বিধুরির ঘটনা দু’টিকে পাশাপাশি রাখলেই দেখা সম্ভব, ভারতীয় গণতন্ত্রের পীঠস্থানে নিষ্পক্ষতা কী ভাবে খণ্ডিত হয়েছে।

মহুয়া মৈত্রের সাংসদ পদ খারিজের সিদ্ধান্তটিকে বিরোধীরা প্রতিহিংসার রাজনীতি বলছেন। অনতি অতীতেই রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজের সিদ্ধান্তটির কথাও ভুললে চলবে না। বিরোধী স্বরের প্রতি শাসক পক্ষের যে অবস্থান গত দশ বছরে দেখা গিয়েছে, এই ঘটনাগুলির সঙ্গে তার সাযুজ্য অনস্বীকার্য। লক্ষণীয় যে, মহুয়ার প্রশ্নে আক্রমণের অভিমুখ ছিল যে ব্যবসায়ীর দিকে, তাঁর সম্বন্ধে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশ করে, এমন একটি সংবাদমাধ্যমের উপরেও সম্প্রতি নেমে এসেছিল একাধিক কেন্দ্রীয় সংস্থার কোপ। হেনস্থা হতে হয়েছিল একাধিক প্রথিতযশা সাংবাদিককে— তাঁরাও সেই ব্যবসায়ীর নানাবিধ কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন করে থাকেন। দেশের শীর্ষনেতারা তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও বেসুরো নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের দমন করতে চান, এ কথা এত দিনে সুপ্রতিষ্ঠিত— সে কাজকে তাঁরা জাতীয় সংহতির পক্ষে অপরিহার্য বলে জনমানসে প্রতিষ্ঠাও করে ফেলেছেন— কিন্তু, কোনও এক ব্যবসায়ীর সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ানোও যদি একই রকম রাষ্ট্রীয় কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা এক নতুন যুগের সূচনা করবে।

আরও পড়ুন
Advertisement