Syed Abdul Nazeer

প্রশ্ন আইনের নয়

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এস আবদুল নাজ়ির অবসর নেওয়ার এক মাসের মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্যপাল পদে তাঁর নিয়োগের সিদ্ধান্তটি এই কারণেই আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৪:৩১
Picture of Former Supreme Court Judge Syed Abdul Nazeer.

সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এস আবদুল নাজির। ছবি: টুইটার।

আইন দিয়ে একটি সভ্য সমাজের সমস্ত রীতিনীতি বেঁধে দেওয়া যায় না। এক অর্থে বলা চলে, আইনের সীমা যেখানে শেষ হয় সেখানেই শুরু হয় প্রকৃত সভ্যতার পরিসর। যে আচরণ কাঙ্ক্ষিত, কোনও আইনি নির্দেশ বা নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই যদি তা একটি সমাজে অনুসৃত হয় তবেই নিশ্চিন্ত হওয়া যেতে পারে যে, সভ্যতা সেই সমাজের স্বাভাবিক ধর্ম। ব্যক্তির আচরণে স্বাভাবিক সংযম মেনে চলবার দায় যতখানি, একটি গণতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্রের চালকদের সেই দায় অন্তত দু’টি কারণে বহুগুণ বেশি। প্রথমত, রাষ্ট্রচালকরা সেখানে জনপ্রতিনিধি হিসাবে শাসন করেন, সুতরাং তাঁদের আচরণ একই সঙ্গে সামাজিক আচরণবিধির প্রতীক এবং তার অন্যতম প্রধান নির্ধারক। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতা তাঁদের হাতে বলেই সেই ক্ষমতা অপব্যবহার না-করার দায়িত্বও তাঁদের উপরে বর্তায়। অপব্যবহারের অর্থ কেবল আইন লঙ্ঘন নয়, সংযমের সীমা অতিক্রম করলেও তা ক্ষমতার অপপ্রয়োগ। এক বার সেই অপপ্রয়োগকে প্রশ্রয় দিলে সচরাচর তা ক্রমাগত বেড়ে চলে।

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এস আবদুল নাজ়ির অবসর নেওয়ার এক মাসের মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্যপাল পদে তাঁর নিয়োগের সিদ্ধান্তটি এই কারণেই আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমালোচনার সঙ্গে শ্রদ্ধেয় বিচারপতি নাজ়ির সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন তোলার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। বিচারপতি নাজ়ির অবশ্যই এক জন অত্যন্ত সম্মাননীয় ব্যক্তি। প্রশ্ন ব্যক্তিগত নয়, পদ্ধতি, রীতি এবং নীতির। সেই প্রশ্ন উঠছে কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পর্কে, যারা এই নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তে কোনও আইন লঙ্ঘিত হয়নি, প্রাক্তন বিচারপতিকে রাজ্যপাল বা অন্য কোনও সরকারি পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত এই প্রথম নেওয়া হল এমনটাও বলা যাবে না। কিন্তু কথায় কথায় যাঁরা সংযম ও সদাচারের অহঙ্কার করেন, কর্তব্যবোধের পরাকাষ্ঠা রূপে নিজেদের জনসমক্ষে তুলে ধরতে যাঁদের ক্লান্তি নেই, তাঁরা সংযমের একটি প্রাথমিক শর্ত লঙ্ঘন করলেন কেন?

Advertisement

শর্তটির কথা অনেকেই বলেছেন, তবে বিশেষ ভাবে স্মরণীয় প্রয়াত অরুণ জেটলির অভিমত, যিনি কেবল বর্তমান শাসক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও মন্ত্রী ছিলেন না, ছিলেন আইনশাস্ত্রের এক স্বীকৃত বিশেষজ্ঞও। তিনি বিভিন্ন প্রসঙ্গে বারংবার বলেছেন, বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের পরে সরকারি কোনও পদে নিয়োগের রীতি বজায় না থাকলেই মঙ্গল, কারণ বিচারের প্রক্রিয়ায় তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। বিরোধী শিবিরে থাকবার সময়েই অবশ্য এই অভিমত তাঁর মুখে বেশি শোনা গিয়েছে, কিন্তু তাতে বক্তব্যের সারবত্তা কমে না। বস্তুত, ভবিষ্যতে অবসরের পরে সরকারি পদ প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকলে কোনও বিচারপতি সেই প্রত্যাশায় শাসকের পক্ষে রায় দেবেন, এমন সংশয় যদি অমূলক হয়, তা হলেও মূল প্রশ্ন থেকে যায়। নিশ্চিত করা দরকার যে, তেমন সংশয়ের অবকাশটুকুও যেন না থাকে। বিশেষত, শাসকদের যথেচ্ছাচারের তাড়নায় বিচারবিভাগের গুরুত্ব বর্তমান ভারতে এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, বিচারপতিদের নিষ্পক্ষতা নিয়ে জনমনে তিলমাত্র প্রশ্ন উঠলেও সেটা গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক। অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণ সংক্রান্ত মামলায় কিংবা নোটবন্দির প্রক্রিয়াগত যৌক্তিকতা নির্ধারণের মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ফলে শাসক দলের সুবিধা হয়েছে। বিচারপতি নাজ়ির দু’টি মামলাতেই অন্যতম বিচারক ছিলেন। রাজ্যপাল পদে তাঁর নিযুক্তির পরে এই ইতিহাস স্মরণ করা হচ্ছে। রাজ্যপালের পদটিকে কেন্দ্রীয় শাসকরা ক্রমাগত নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহার করেন বলেই এই ধরনের আলোচনা এবং তার অন্তর্নিহিত সংশয় আরও জোরদার হয়। এমন আলোচনা অবাঞ্ছিত, এই সংশয়ের উল্লেখমাত্রও উদ্বেগজনক।

আরও পড়ুন
Advertisement