TMC

বদ্ধভূমি

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক জন বিচক্ষণ প্রশাসক, বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তাঁর কাছে প্রত্যাশিত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০২২ ০৫:৩৪

একুশে জুলাই: এখনও তারিখটি ক্যালেন্ডারে লালকালিরঞ্জিত পার্বণের দিন নয়, কিংবা ঘোষিত সরকারি ছুটির দিন নয়। দ্রুত এর সংশোধন বিধেয়। নতুবা নাগরিকেরা অনেকেই আগেভাগে খেয়াল করেন না, তৃণমূল কংগ্রেসের শহিদ দিবস নামক একটি বাৎসরিক মহোৎসবের জন্য চিত্তপট প্রস্তুতিতে বিলম্ব ঘটে যায়, আগাম পরিকল্পনার অভাবে আবালবৃদ্ধবনিতাপুরুষ খামোকা নাজেহাল হন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক জন বিচক্ষণ প্রশাসক, বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তাঁর কাছে প্রত্যাশিত। কেননা, কেবল একটিমাত্র দিন তো নয়, অভিজ্ঞতা বলছে তার আগে কয়েকটি দিন জুড়ে কলকাতা শহরের মানুষ স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতে পারেন না, ‘একশো শতাংশ’ বাস উঠে গিয়ে গণপরিবহণ বস্তুটি কার্যত ভেঙে পড়ে, কর্মস্থল যাওয়া বা অন্যান্য জরুরি কাজ করা যুদ্ধে যাওয়ার শামিল হয়, সন্ত্রস্ত অফিসযাত্রীরা একটি দিন ছুটি নিতে বাধ্য হন, পড়ুয়াদের স্কুলে পাঠানো দুরূহ বলে ইতিমধ্যে-অপ্রয়োজনীয় পড়াশোনা বস্তুটি আরও এক দিন ব্যাহত হয়— হাতে যথেষ্ট সময় নিয়ে নাগরিককে এই সকল কিছুর জন্য আগে থেকে প্রস্তুত করে দেওয়া চাই। যে হেতু উৎসবের অকুস্থলটি একেবারে রাজধানী কলকাতা মহানগরীর হৃদয়ভূমি, সে দিন উষালগ্ন থেকে অনুগত জনতার স্রোত প্রতি প্রান্ত থেকে কেন্দ্রের দিকে বয়, গোটা শহর এক ‘বদ্ধভূমি’ হয়ে ওঠে— তাই পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও গোটা দেশে একুশে জুলাইকে লালকালির দিন বলে বিজ্ঞাপিত করা জরুরি।

এত লোক এসে গিয়েছে যে সামলানো যাচ্ছে না— এ বছর আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন লোক-আনানোর কান্ডারিরাই। বিচিত্র পরিস্থিতি বটে, যেখানে শাসকরা অসংখ্য অনুগতের উপস্থিতিতে শক্তি-সমৃদ্ধি অনুভব ও উপভোগ করতে চান জেনে আরও অসংখ্য মানুষ অনুগত হওয়ার আপ্রাণ তাড়নায় এসে পড়ে পরিস্থিতি দুর্বহ করে তোলেন। বিভিন্ন স্টেডিয়াম ও বাসস্থল ভিড়ের চাপে ভেঙে পড়ার জোগাড়। সহজেই অনুমেয়, ভিড়ে যাঁরা আছেন, তাঁদেরও নিশ্চয়ই অসীম ক্লেশাবস্থার জোগাড়! দূরদূরান্ত থেকে এত মানুষ কেন আসেন এত ক্লেশ স্বীকার করতে হবে জেনেও? প্রশ্নের উত্তরটি রাজনীতিভিত্তিক। শাসকের বিরুদ্ধে নয়— শাসকের পক্ষে, এগারো বছর ধরে শাসনকারীর হয়ে নিজেদের উপস্থিতি প্রদর্শনের জন্য জনসাধারণের এই প্রাণান্ত প্রয়াসকে স্বতঃস্ফূর্ত ও আবেগমথিত বলতে দ্বিধা হয়, অনৃতভাষণও হয় বটে।

Advertisement

‘প্রাণান্ত’ শব্দটিতে যদি বা কিছু আতিশয্য থাকে, অন্ততপক্ষে প্রাণ‘পণ’ উপস্থিতি একে বলাই যায়। প্রাণ হাতে করেই এই বিশাল সংখ্যক মানুষ ভিড়ে ঠেলাঠেলি করছেন, সমাবেশে মুখ দেখাচ্ছেন। এক দিকে রাজ্য প্রশাসনই নবপর্বেরকোভিডের চোখরাঙানিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলছে, অন্য দিকে তারাই এই অরাজক পরিস্থিতির আয়োজক। সংক্রমণের আশঙ্কা তুড়ি মেরে উড়িয়ে এই বিপুল জনসমুদ্র আহ্বানের ফল কী দাঁড়ায় দেখা যাক, কিন্তু যদি বিরাট সঙ্কট কিছু না-ও ঘটে, তবুও কি সরকারের তরফে এ-হেন কার্যক্রম চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নয়? এ রাজ্য আগের তিনটি কোভিড পর্বে কম ক্ষতি দেখেনি। আবারও এই ত্রাসের মুখে রাজ্যবাসীকে এগিয়ে দেওয়া কি আবশ্যিক ছিল? দুই বছর শহিদ দিবস উদ্‌যাপন হয়নি, এ বছরও নাহয় বাদ থাকত। প্রসঙ্গত, আর একটি সঙ্গোপন প্রশ্ন: যে দল রাজ্যের মসনদে তৃতীয় বারেও অবিসংবাদী বিজয়ী, তার এই শক্তিপ্রদর্শনের চরম আগ্রহ ও উৎকণ্ঠা কিসের জন্য? নেত্রীনেতারা নিশ্চয় জানেন, জনসমর্থন কেবল সমাবেশ তৈরি করে নিশ্চিত করা যায় না। তার জন্য চাই আলাদা কার্যক্রম, আলাদা ভাবনাচিন্তা— না কি সেখানে কিছু কম পড়তে পারে ভেবেই কোভিডভয় হেলা করেও বিপদসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ার এই নাচার পথ?

আরও পড়ুন
Advertisement