Food Delivery Apps

অস্পৃশ্যতার কলুষ

নানা জাতীয় সমীক্ষা দেখিয়েছে, ভারতীয় হিন্দুদের অধিকাংশই মাছ-মাংস খান। তা সত্ত্বেও হিন্দুত্ববাদীরা ভারতে নিরামিষভোজীদের সংখ্যাগুরু বলে দাবি করে চলেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২৪ ০৮:০৬

— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

নানা অছিলায় এখনও অস্পৃশ্যতা নামক কদর্য প্রথাটি ভারতের সমাজে ডালপালা মেলতে চাইছে, তা ফের স্পষ্ট হল একটি খাবার ডেলিভারি সংস্থার সিদ্ধান্তে। রেস্তরাঁ-দোকান থেকে ক্রেতার বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য সংস্থাটি নিরামিষ খাবার পাঠানোর জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করেছিল— আমিষ এবং নিরামিষ খাবার যাতে পরস্পরের সংস্পর্শে না আসে, সে জন্য খাবারের প্যাকেটগুলি ভিন্ন ব্যাগে বহন করা হবে, বাহকরাও হবেন ভিন্ন। যুক্তি ছিল, ভারতে সর্বাধিক নিরামিষাশীর বাস, এবং তাঁরা আমিষের গন্ধ এড়াতে চান। বাজারের চাহিদা মেটানোই পরিষেবা প্রদানকারী কাজ, অতএব এতে সারা দেশে আপত্তি উঠছে কেন, তা ওই সংস্থা বুঝতে পারেনি। বৃহত্তর মানুষ অবশ্য একমত হবেন যে, ওই আপত্তিটুকুর সূত্র ধরেই ভারত নামক দেশটিকে আজও খুঁজে পাওয়া যায়। ভক্ষ্য-অভক্ষ্যের বিচার দিয়ে শুরু করে সমাজে ছুতমার্গ কায়েম করে জাতিপ্রথা গভীর ক্ষত বহন করেছিল, আজও তার বেদনা বহন করতে হচ্ছে দেশকে। অস্পৃশ্যতার যে বিষবৃক্ষকে উপড়ে ফেলতে আজীবন লড়াই করেছেন বিবেকানন্দ, গান্ধী, আম্বেডকরের মতো নেতারা, একবিংশের ভারতে কিছুতেই তাকে মাথা তুলতে দেওয়া চলে না। কোথাও তার কোনও চিহ্ন দেখামাত্র সমূলে উৎপাটনই দেশপ্রেমিকের কর্তব্য।

Advertisement

নানা জাতীয় সমীক্ষা দেখিয়েছে, ভারতীয় হিন্দুদের অধিকাংশই মাছ-মাংস খান। তা সত্ত্বেও হিন্দুত্ববাদীরা ভারতে নিরামিষভোজীদের সংখ্যাগুরু বলে দাবি করে চলেছে। আমিষাশীদের ‘অপর’— অর্থাৎ নিম্নবর্ণ বা অহিন্দু বলে দেখাতে চায়। তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রশ্রয়েই নব নব রূপে ছুতমার্গের প্রকাশ ঘটছে। ‘ক্রেতা অধিকার’ বলে আমিষ-স্পর্শ বর্জন তেমনই রূপ। নিরামিষ খাওয়া ব্যক্তির অভিরুচি। কিন্তু আমিষ খাবারের স্পর্শ এড়াতে হবে নিরামিষ খাবারকে, এমন দাবি কেন? সারা বিশ্বেই নিরামিষাশী মানুষ আছেন। আমিষ বহনকারী মানুষ, কিংবা আমিষ ভক্ষণকারী মানুষের সংস্পর্শ পরিহার করতে হবে, এমন দাবি কেউ করেন না। ক্রেতাও তেমন পরিষেবা দাবি করতে পারেন না। গান্ধীজির কথা মেনে বলা চলে, এমন দাবি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। সংস্থাটির প্রধান জানিয়েছেন, বহু ক্ষেত্রে তাঁদের কর্মীদের আবাসনে ঢুকতেই দেওয়া হয় না, তাঁরা আমিষ খাবারও বহন করেন বলে। এ থেকেই অস্পৃশ্যতা অভ্যাসকারীর মনোভাব স্পষ্ট হয়।

‘আমিষ পরিহার’ থেকে কিছু অবিবেচক মানুষকে ‘আমিষাশী পরিহার’-এর দিকে কত সহজে ঠেলে দেওয়া যায়, গোরক্ষকদের তাণ্ডবেই তা প্রমাণিত। ২০১২-২০২৩ সময়কালে আশিরও বেশি ব্যক্তি মহিষ বা আর কোনও মাংস আহারের জন্য খুন হয়েছেন। শিশুদের প্রোটিনের অভাব সত্ত্বেও বহু রাজ্যে স্কুলগুলি ঝুঁকছে নিরামিষের দিকে। দলিত মেয়েদের রান্না খেতে আপত্তি উঠছে। বস্তুত ‘পিয়োর ভেজিটেরিয়ান’ শব্দবন্ধটির মধ্যেই ছুতমার্গের দ্যোতনা রয়েছে। ইংরেজির ‘পিয়োর’ শব্দটির অর্থ ‘পবিত্র’ কিংবা ‘কলুষশূন্য’। এই শব্দের প্রয়োগে খাবারকে ‘আমিষমুক্ত’ বলার সঙ্গে আমিষ তথা আমিষাশীকে কলুষ বলে চিহ্নিত করা হয়ে যায়। তাই বাণিজ্যিক সংস্থাগুলিকে এর ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। অস্পৃশ্যতার রাজনীতি ভারতের সমাজকে সর্বাধিক দ্বিধাবিভক্ত, দুর্বল করেছে। পুরনো ভুলকে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না।

আরও পড়ুন
Advertisement