Demonitisation

পাঁচ বৎসর পর

নগদহীন অর্থব্যবস্থা চালু করিবার (বেসরকারি) তাগিদ সরকারের থাকিতে পারে— কিন্তু, তাহার জন্য এমন দানবীয় ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২১ ১০:১১

অর্থনীতিবিদদের প্রশংসা পাইবার সৌভাগ্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সচরাচর হয় না। পাঁচ বৎসর পূর্বে এক বার হইয়াছিল। পরবর্তী কালের নোবেলবিজয়ী অর্থশাস্ত্রী, আচরণবাদী অর্থনীতির প্রসিদ্ধ তাত্ত্বিক রিচার্ড থেলার যখন শুনিলেন যে, কালো টাকার বিরুদ্ধে জেহাদে মোদী পাঁচশত ও হাজার টাকার নোট বাতিল করিয়াছেন, তিনি প্রশংসাজ্ঞাপক টুইট করিলেন। কিন্তু, হায়! সেই প্রশংসা পদ্মপাতায় জলমাত্র। কারণ, তাহার পরই যখন থেলার শুনিলেন যে, হাজার টাকার নোটের বদলে মোদী দুই হাজার টাকার নোট বাজারে আনিয়াছেন, তিনি স্তম্ভিত! থেলারের সেই হতবাক বিস্ময়ই ডিমনিটাইজ়েশনের সম্পূর্ণ গল্পটিকে ধরিয়া দেয়। একটি সুবৃহৎ অর্থনীতির কর্ণধাররা যে এতখানি দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিতে পারেন, তাহা জানিবার পর স্তম্ভিত হওয়া ভিন্ন কী বা করিবার থাকিতে পারে! নোট বাতিলের পাঁচ বৎসর কাটিয়া গেল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বা তাঁহার কোনও অর্থমন্ত্রীই আজ অবধি সেই প্রক্রিয়ার জমা-খরচের হিসাব পেশ করিয়া উঠিতে পারিলেন না। এমনকি, কোন লক্ষ্য পূরণের জন্য তাঁহারা এমন অর্থনীতিমেধ যজ্ঞ করিয়াছিলেন, সেই প্রশ্নের কোনও সুস্পষ্ট উত্তরও অদ্যাবধি নাই। ৮ নভেম্বর, ২০১৬ তারিখে সরকারি উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সম্ভবত একটি কথাই নিশ্চিত ভাবে বলা যায়— সেই দিন দেশবাসীর মনে একটি ভীতির সঞ্চার করিতে চাহিয়াছিলেন প্রধানমন্ত্রী; টেলিভিশনের পর্দায় জাতির উদ্দেশে তাঁহার ভাষণের ভয়। অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, সেই কাজে তাঁহারা সফল। দূরদর্শনে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিবেন, শুনিলেই জাতির মেরুদণ্ড বাহিয়া শীতল স্রোত নামিয়া যায়!

নোট বাতিলের সিদ্ধান্তটি মোদীর ‘মাস্টারস্ট্রোক’ কেন, সেই বিষয়ে পাঁচ বৎসর পূর্বে অন্তত পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্ব খাড়া করা হইয়াছিল— তাহাদের অধিকাংশই সরকারি। কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ তাহার প্রথম। অর্থব্যবস্থা সম্বন্ধে ধারণা অতি দুর্বল না হইলে তাঁহারা বুঝিতেন, কালো টাকার সিংহভাগই মজুত থাকে উপার্জনশীল সম্পদে— অর্থাৎ, যে সম্পদ সুদ বা লাভ অর্জন করিতে পারে, তাহাতে। ফলে, নোট বাতিল করিলেই মজুত কালো টাকাও ধ্বংস হইবে, এ-হেন বালখিল্য যুক্তির মুখে ছাই দিয়া ‘কালো অর্থনীতি’ বহাল থাকিয়াছে, পুষ্পে-পত্রে বিকশিত হইয়াছে। যতটুকু নগদ কালো টাকা ছিল, বিভিন্ন পথ ঘুরিয়া তাহাও ব্যবস্থায় ফিরিয়া আসিয়াছে। সরকারি জনধন অ্যাকাউন্ট তাহাতে অতি সহায়ক হইয়াছিল। দ্বিতীয় যুক্তি ছিল, এই ব্যবস্থায় নকল নোটের কারবার ধ্বংস হইয়া যাইবে। ২০২০ সালের পরিসংখ্যান বলিতেছে, ভারতে মোট যত নকল নোট আছে, তাহার প্রায় ষাট শতাংশ ২০০০ টাকার নোট— ডিমনিটাইজ়েশনের মহালগ্নে যাহার জন্ম! তৃতীয় যুক্তি, নোট বাতিলের ফলে জঙ্গিরা মুশকিলে পড়িবে, ফলে ভারতে সন্ত্রাসবাদী হামলার সংখ্যা কমিবে। অন্যান্য জঙ্গি হামলার কথা যদি বাদও রাখা যায়, ২০১৯ সালের নির্বাচনের পূর্বাহ্ণে পুলওয়ামার হামলাটির কথা ভোলা মুশকিল। এই যুক্তিগুলির পাশাপাশি সরকার জানাইয়াছিল, নোট বাতিলের মাধ্যমে ভারত নগদহীন অর্থব্যবস্থা হইয়া উঠিবে। খেয়াল থাকিতে পারে, সেই সময় এক ই-ওয়ালেটের বিজ্ঞাপনে মুখ দেখাইয়াছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। ফলে, নগদহীন অর্থব্যবস্থা চালু করিবার (বেসরকারি) তাগিদ সরকারের থাকিতে পারে— কিন্তু, তাহার জন্য এমন দানবীয় ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল না। তদুপরি, নোট বাতিলের সময়ে ভারতের বাজারে মোট যত নগদ ছিল, এখন বাজারে নগদের পরিমাণ তাহার দ্বিগুণ। অর্থাৎ, বহু মানুষকে কষ্ট দিল, দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের কোমর ভাঙিল, বহু মানুষকে কর্মহীন করিল যে ডিমনিটাইজ়েশন, পাঁচ বৎসরে তাহার সাফল্যের ঘরে মহাশূন্য।

Advertisement
আরও পড়ুন
Advertisement