কোভিড সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের নীতি এবং উদ্যোগ বিষয়ে প্রশ্ন তুলিলেই একটি প্রতিপ্রশ্ন উঠিতেছে: দায় কি কেবল সরকারের, নাগরিকের কোনও দায়িত্ব নাই? রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও নাগরিকদের ‘নিজেদের স্বার্থেই’ কোভিড বিধি মানিতে বলিয়াছেন। সামাজিক মঙ্গল বিধানে অবশ্যই প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব আছে; এবং, এই রাজ্যে বহু নাগরিক সেই দায়িত্ব পালনে কেবল ব্যর্থ নহেন, উদাসীন। তাঁহারা যে ভাবে অতিমারির কালে বিনা কারণে সমস্ত নিয়মকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া জনপরিসরে ঘুরিয়া বেড়ান এবং সেই বিষয়ে প্রশ্ন তুলিলে নানা ভাবে বলিয়া দেন যে তাঁহারা জানিয়া-শুনিয়াই শৃঙ্খলা ভাঙিতেছেন, তাহা কেবল ব্যক্তিগত অপরাধ নহে— এই প্রবণতা পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কেই গভীর দুশ্চিন্তার কারণ। কিন্তু ইহাতে সরকার তথা ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের দায় কমে না, বরং বাড়ে। সামাজিক আচরণে বিশৃঙ্খলা নিবারণের প্রাথমিক কর্তব্য পালনে শাসকরা ব্যর্থ হইলে নাগরিকদের একটি বড় অংশ বিচারবুদ্ধি শিকেয় তুলিয়া বেপরোয়া আচরণ করিবেন, তাহা অস্বাভাবিক নহে। বিশৃঙ্খলা স্বভাবত নিম্নগামিনী।
সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল প্রশাসনের শর্ত পূরণে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদের ঘাটতি বিরাট। হয়তো তাহার পিছনে তাঁহাদের তথাকথিত ‘জনবাদী’ রাজনীতির প্রভাব আছে। সেই রাজনীতির ভিত্তিতে কোনও সুচিন্তিত মতাদর্শ বা সুপরিকল্পিত কর্মসূচি কোনও দিনই ছিল না, আজও নাই। এই অ-পরিকল্পনার কল্যাণেই তাঁহারা প্রতি মুহূর্তে নূতন নূতন কৌশল উদ্ভাবন করিতে পারেন, তাহা নির্বাচনী রাজনীতিতে উচ্চফলনশীল হইতে পারে, কিন্তু এই তাৎক্ষণিকতা প্রশাসনের— প্রকৃষ্ট শাসনের— প্রতিকূল। প্রশাসন দাবি করে সুচিন্তিত নীতি ও তাহার সুষ্ঠু প্রয়োগের ভিত্তিতে শাসন-প্রক্রিয়ার সুস্থির পরিচালনা। পশ্চিমবঙ্গের শাসন-প্রক্রিয়ায় এই সুস্থিরতার অভাব সাধারণ ভাবেই প্রকট, অতিমারির কালে অস্থিরতার মাত্রা অস্বাভাবিক ভাবে বাড়িয়াছে। সরকারি নীতির তাড়নায় বহু নাগরিক নিরুপায় হইয়া সংক্রমণের ঝুঁকি লইতেছেন; যাঁহারা স্বভাবত বেপরোয়া, তাঁহাদের স্বভাবে বাড়তি ইন্ধন দিতেছে সরকারি আচরণের অস্থিরতা। এক এক দিন ধমক দিয়া, ইতস্তত পুলিশি ধরপাকড় চালাইয়া এই পরিস্থিতির সুরাহা সম্ভব নহে। সরকারকে নাগরিকের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করিতে হইবে। তাহার জন্য প্রকৃষ্ট শাসনের নিত্যকর্মপদ্ধতিতে ফিরিতে হইবে। প্রয়োজনে অভিজ্ঞদের পরামর্শ চাহিতে হইবে— নিছক চটকদার ‘উপদেষ্টামণ্ডলী’ বানাইয়া নহে, আন্তরিক শুশ্রূষা সহকারে।
এই আত্মশুদ্ধির জন্য সর্বাগ্রে আবশ্যক সস্তা জনপ্রিয়তার ঊর্ধ্বে উঠিবার ইচ্ছা ও সাহস। জনপ্রিয়তা মূল্যবান। কিন্তু সর্ব বিষয়ে জনপ্রিয় থাকিবার আকাঙ্ক্ষায় বেসামাল হইলে নেতৃত্ব কথাটিই অর্থহীন হইয়া পড়ে। তখন নেতা বা নেত্রী জনতার পিছু পিছু দৌড়াইতে থাকেন, সংক্রমণের নূতন পর্ব আসন্ন জানিয়াও বড়দিন, বর্ষশেষ, বর্ষবরণ, এমপি কাপ ইত্যাদি জন-উৎসব বন্ধ না করিয়া তাহাতে প্রশ্রয় দেন। তাঁহারা আর কবে বুঝিবেন যে সমাজের কল্যাণে অনেক সময়েই বহুজনের অপ্রিয় কিছু সিদ্ধান্ত লইতে হয়, তাহাতে হাততালি মিলে না, কিন্তু যথার্থ নেতৃত্বের প্রমাণ মিলে। তাহার পরিবর্তে সরকার, এখনও, এক দিকে জনতাকে বাঁধা গতে বিধি মানিতে বলিয়া এবং ইতস্তত অবরোধ বসাইয়া বা রাত্রিকালীন কার্ফু ইত্যাদি অসার হুকুম জারি করিয়া আপন তৎপরতা দেখাইতে ব্যস্ত, অন্য দিকে সরকারি কৌঁসুলি আদালতে নানা ‘যুক্তি’ সাজাইয়া গঙ্গাসাগর মেলা চালু রাখিবার সওয়াল করিতেছেন, আর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী জানাইতেছেন গঙ্গাসাগর বিষয়ে যাহা করিবার আদালত করিবেন। বাংলা নাটকের জাহানারা কহিতেন: আবার বলি, চমৎকার!