আরও একটি বাজেট আসিয়া গেল। আরও এক বার সংসদ ভবন আলো করিয়া বসিবেন সদস্যরা, আরও এক বার অর্থমন্ত্রী তাঁহার বাজেট ভাষণ পেশ করিবেন। প্রতিশ্রুতির বন্যা বহিবে, কোনও গোষ্ঠী হতাশও হইবে। কিন্তু, তাহারও অধিক গুরুতর একটি কাজ আছে— গত বাজেটে অর্থমন্ত্রী যে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন, তাহা কতখানি পূরণ হইল এক বৎসরে, সেই হিসাব গ্রহণ। সর্ব ক্ষেত্রে বাজেটের প্রতিশ্রুতি রক্ষিত হয় না— অনেক ক্ষেত্রে সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের উপর সরকার পক্ষের নিয়ন্ত্রণও থাকে না। কিন্তু, যদি প্রতিশ্রুতি পূরণ না হইবার প্রবণতাটি ধারাবাহিক হয়, তবে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে কারণটি আকস্মিক নহে, বরং কাঠামোগত। বিলগ্নিকরণ তেমনই একটি উদাহরণ। গত কয়েকটি বাজেটে অর্থমন্ত্রী রেকর্ড পরিমাণ বিলগ্নিকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন, এবং প্রতি বারই সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিতে ব্যর্থ হইয়াছেন। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে বিলগ্নিকরণের মাধ্যমে এক লক্ষ পাঁচ হাজার কোটি টাকা আয়ের হিসাব পেশ করা হইয়াছিল। প্রকৃত সংখ্যাটি তাহার ধারেকাছেও পৌঁছায় নাই। পরবর্তী অর্থবর্ষে প্রতিশ্রুতি ছিল দুই লক্ষ দশ হাজার কোটি টাকার— বৎসর শেষে দেখা গেল, লক্ষ্য হইতে এক লক্ষ আটাত্তর হাজার কোটি টাকা কম উপার্জন হইয়াছে। বর্তমান অর্থবর্ষেও প্রতিশ্রুত বিলগ্নিকরণ হইবে না ধরিয়া লওয়া যায়। এয়ার ইন্ডিয়ার বিলগ্নিকরণ সম্ভব হইয়াছে বটে, কিন্তু এমনই মূল্যে যে সরকারের কোষাগারে প্রত্যাশিত রাজস্ব আসে নাই। দুইটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বিলগ্নিকরণও বকেয়া থাকিয়া গিয়াছে। ৩১ মার্চের মধ্যে জীবন বিমা নিগমের বিলগ্নিকরণের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হইলেও পর পর তিন বৎসর বিলগ্নিকরণের প্রশ্নে সরকার প্রতিশ্রুত স্তরে পৌঁছাইতে ব্যর্থ হইবে বলিয়াই আশঙ্কা। রাজস্ব আদায়ের হিসাবটি যদি এই ভাবে গুলাইয়া যাইতে থাকে, তবে রাজকোষ ঘাটতির অঙ্কও স্বভাবতই মিলিবে না।
অন্য দিকে, জাতীয় কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনার উদাহরণটি দেখিলে বোঝা যাইবে, সেখানেও ব্যর্থতার কারণটি কাঠামোগত। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে অতিমারির ধাক্কা সামলাইতে এনআরইজিএ-র ব্যয়ের পরিমাণ বাজেট বরাদ্দের তুলনায় অনেকখানি বাড়াইতে হইয়াছিল। পরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী সেই বরাদ্দ ছাঁটিয়া ফের পুরাতন মাপে ফিরাইয়া দেন। তাহার পর, গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে যে, বাজেট বরাদ্দের অতিরিক্ত আরও ২৫,০০০ কোটি টাকা এই খাতে দেওয়া হইবে, বকেয়া মজুরি প্রদান করিতে। ইহা এই এক বৎসরের সমস্যা নহে— গত বৎসরও ২১,০০০ কোটি টাকার অধিক খরচ হইয়াছিল বিগত বৎসরের বকেয়া প্রদান করিতে। দেখা যাইতেছে, গত পাঁচ বৎসর গড়ে এনআরইজিএ-র বরাদ্দের ২০ শতাংশ বকেয়া প্রদানে ব্যয় হইতেছে। অর্থাৎ, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্রেও অর্থবরাদ্দের হিসাবে যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্যতা নাই। এবং, ঘটনাটি ধারাবাহিক ভাবেই ঘটিয়া চলিতেছে। একটি হিসাব অনুসারে, দেশে যত পরিবার একশত দিনের কাজ করিতে চাহে, তাহাদের সব কয়টিকেই যদি একশত দিন কাজ দিতে হয়, তবে এই খাতে আড়াই লক্ষ কোটি টাকার অধিক বরাদ্দ প্রয়োজন। বাজেটে তেমন ঘটনা ঘটিবে, সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। ফলে, কাঠামোগত খামতি থাকিয়াই যাইবে। এই অর্থবর্ষে সরকারের আর একটি লক্ষ্য ছিল পরিকাঠামো ক্ষেত্রে ব্যয়। বাজেটে প্রায় দুই লক্ষ কোটি টাকাও বরাদ্দ হইয়াছিল। কিন্তু, গত মাসে জানা গেল, দেশ জুড়িয়া প্রায় দেড়শত পরিকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প বিলম্বে চলিতেছে। এই ত্রুটিগুলি মেরামত না করিতে পারিলে বাজেটে নূতনতর প্রতিশ্রুতি কি শেষ অবধি কথার কথাই হইয়া থাকিবে না? ভবিষ্যতের দিকে চাহিতে হইলে অতীতের ভ্রান্তিগুলি মেরামত করিয়া লইতে হয়।