ভীমরাও রামজি আম্বেডকর।
গত একশো বছরে ভারতীয় রাজনীতি একটি কথা বুঝেছে— ভীমরাও রামজি আম্বেডকর নামক ব্যক্তিকে অস্বীকার করা যেমন কঠিন, স্বীকার করাও তেমনই কঠিন। আজও সেই উভয়সঙ্কট রাজনীতির পিছু ছাড়েনি। গান্ধী-নেহরুর সঙ্গে তাঁর বিরোধ বিজেপির কাছে তাঁকে আকর্ষণীয় করেছে, কিন্তু আম্বেডকরের লেখালিখির সঙ্গে বিন্দুমাত্র পরিচয় থাকলেই বোঝা সম্ভব যে, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পক্ষে তাঁকে পূর্ণ মহিমায় গ্রহণ করা অসম্ভব। কারণ, তাঁর রাজনীতির বোধটি অঙ্কুরিত হয়েছে মনুবাদী সমাজের ঘৃণার প্রতিক্রিয়ায়। সম্ভবত সে কারণেই, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি আম্বেডকরকে দেখাতে চায় একটি বিমূর্ত ধারণা হিসাবে— রক্তমাংসের মানুষ হিসাবে নয়। তাঁর জীবন নিয়ে, তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে আদৌ কথা হয় না। কোনও নেতার— বা বৃহত্তর অর্থে, নায়কের— জীবনসংগ্রাম রাজনীতির একটি পছন্দসই উপাদান— এমনকি, কল্পিত ‘সংগ্রাম’ হলেও কাজ চলে যায়। অথচ, আম্বেডকরের জীবনের গল্পকে রাজনীতি তেমন ব্যবহার করেনি— প্রত্যক্ষ ভাবেও না, বলিউডি সিনেমার ঘুরপথেও না। তার একটা সম্ভাব্য কারণ হল, তাঁর ক্লেশ আর্থিক অবস্থাজনিত নয়। তাঁর পিতা সেনাবাহিনীতে সুবেদার পদে কর্মরত ছিলেন। আর্থিক সঙ্কট থেকে উত্তরণের গল্পটি চিরকালই রূপকথার বিষয়বস্তু— সে লড়াই এককের; এবং এমন একটি শ্রেণির বিরুদ্ধে, বেশির ভাগ মানুষই নিভৃতে যে শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হতে চান, কিন্তু প্রকাশ্যে তার বিরোধিতা করতে বাধে না। ‘দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াই’ ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের ভিতকে প্রশ্ন করে না— বরং, তা যোগ্যতমের উদ্বর্তনের প্রক্রিয়া হিসাবেই গণ্য হয়।
আম্বেডকরের লড়াই ছিল বর্ণাশ্রমের বিরুদ্ধে। তিনি তাঁর শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, তাঁদের সমস্ত জামাকাপড় কাচতে হত তাঁর দিদিকেই— ধোপার খরচ দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না বলে নয়, জাতিপরিচয়ের কারণে ধোপারা তাঁদের কাপড় কাচতেন না বলে। তাঁর আত্মজীবনীমূলক পুস্তিকা ওয়েটিং ফর আ ভিসা-য় আম্বেডকর তাঁর শৈশবের এক যাত্রার কথা লিখেছেন। তিনি ও তাঁর দাদা, দু’জনেই নিতান্ত বালক, যাচ্ছিলেন পিতার কর্মক্ষেত্রে। সেই যাত্রাপথে বহু বার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরে এক গাড়োয়ান রাজি হয়েছিলেন তাঁদের নিয়ে যেতে— শর্ত, সেই গাড়ি চালাতে হবে বালকদেরই; ‘নিচু জাত’-এর গাড়ি চালাতে পারবেন না তিনি। ঘটনাটি ১৯০১ সালের। তার প্রায় তিন দশক, এবং আমেরিকার কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচ ডি অর্জনের পরে, ১৯২৯ সালে বোম্বাই প্রদেশের সরকার নিয়োজিত কমিটির সদস্য হিসাবে চালিসগাঁও নামক এক জায়গায় গিয়ে একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলেন তিনি। সেখানেও কোনও কোচোয়ান এক ‘অচ্ছুত’-কে নিজের গাড়িতে তুলতে নারাজ। অর্থাৎ, আর্থিক সামর্থ্য, শিক্ষাগত যোগ্যতা, বৌদ্ধিক উত্তরণ— সামাজিক চলমানতার ক্ষেত্রে মানুষের ‘লড়াই’-এর পরিচিত এবং প্রত্যাশিত সমস্ত তির তাঁর তূণীরে থাকা সত্ত্বেও আম্বেডকরের একমাত্র পরিচয় ছিল তিনি ‘অচ্ছুত’। কোন পথে এই পরিচয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়?
পথ একটিই— বর্ণাশ্রমের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই। আম্বেডকর দ্ব্যর্থহীন ভাবে সে পথে হেঁটেছিলেন। অ্যানাইহিলেশন অব কাস্ট-এ তিনি লেখেন, “বর্ণাশ্রমের মতো আদ্যন্ত নেতিবাচক সমাজব্যবস্থা আর দ্বিতীয়টি নেই— এই আদর্শ মানুষকে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে, পঙ্গু করে;” “হিন্দু সমাজের নৈতিকতার উপরে বর্ণব্যবস্থার নেতিবাচক প্রভাব অতি নিন্দনীয়... জাতপাত মানুষের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ, পরার্থপরতার ধারণাকে ধ্বংস করেছে।” এবং, তিনি জানান, ভিন জাতের লোকের সঙ্গে একাসনে খেয়ে (অর্থাৎ কিনা, জাতপাতের বিরুদ্ধে যে অস্ত্র ব্যবহার করার পক্ষপাতী ছিলেন গান্ধী), অথবা ভিন জাতে বিয়ের ব্যবস্থা করে এই বর্ণাশ্রম ব্যবস্থাকে ভাঙা যাবে না— যে ধর্মীয় বিশ্বাসের উপরে ভিত্তি করে এই ব্যবস্থাটি গড়ে উঠেছে, ধ্বংস করতে হবে তাকে। আম্বেডকর নিজের প্রতিপক্ষ হিসাবে খাড়া করছেন গোটা ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজব্যবস্থাকে— ভারতীয় সমাজের হেজেমনিক শক্তিকেন্দ্রটিকেই। ফলে, সে লড়াইয়ে তিনি একা। তাঁকে ‘সংবিধানের জনক’ বলে ‘সম্মান’ জানানোর পরও তিনি কেবলমাত্র নিম্নবর্ণের আইকন। তাঁর লড়াইয়ের গল্পকে ব্রাহ্মণ্য-আধিপত্যাধীন ভারতীয় সমাজ স্বীকার করতে পারেনি, কারণ সেই গল্পের খলনায়কের ভূমিকায় তার উপস্থিতি প্রশ্নাতীত। গৈরিক রাজনীতি এই সত্যটি জানে। তবে, উত্তর-সত্যের যুগ তাকেও গুলিয়ে দেবে না, সে ভরসা ক্ষীণ।