Bangladesh

নেতা ও জনতা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার ও অব্যবহিত পরে করাচির জেলে নিক্ষেপ করে পাক সেনা ও সরকার ভেবেছিল, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’-এর স্বপ্নদীপ এখানেই নির্বাপিত। তাদের অনুমান যে কতটা ভুল, প্রমাণ করে দিয়েছিল পরের নয়টি মাসে জনতার সংগ্রাম ও বিজয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৫ ০৭:২৩

বিগ বার্ড ইন কেজ, স্মল বার্ডস হ্যাভ ফ্লোন।” চুয়ান্ন বছর আগে ২৫ মার্চ পেরোনো গভীর রাতে ঢাকার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের এক সেনা মেজর ওয়্যারলেসে এই বার্তা পাঠিয়েছিলেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। ছোট পাখিগুলি উড়ে গেলেও, খাঁচায় বন্দি করা গেছে বেশি ডানা ঝটপটানো বড় পাখিটিকে— কর্তৃপক্ষের নিশ্চয়ই স্বস্তিবোধ হয়েছিল জেনে। ১৯৭১-এর সেই রাতেই ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হয়েছে ঢাকায়— নিরস্ত্র পূর্ব পাকিস্তানি তথা বাঙালিদের নির্মম ধরপাকড়, নির্যাতন, হত্যা। এক দিকে নির্বিচারে গণদমন, অন্য দিকে স্বাধীনতার মুখ গণনেতাটিকে প্রথমেই বন্দি করে ফেলা— দেশ-কাল ভেদে যে কোনও গণআন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম বা যুদ্ধে প্রধানতম অস্ত্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার ও অব্যবহিত পরে করাচির জেলে নিক্ষেপ করে পাক সেনা ও সরকার ভেবেছিল, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’-এর স্বপ্নদীপ এখানেই নির্বাপিত। তাদের অনুমান যে কতটা ভুল, প্রমাণ করে দিয়েছিল পরের নয়টি মাসে জনতার সংগ্রাম ও বিজয়।

Advertisement

দেশে দেশে, যুগে যুগে বহু আন্দোলন, প্রতিরোধ ও যুদ্ধ হয়েছে, এখনও হয়ে চলেছে। কিন্তু এ-হেন উদাহরণ হাতে গোনা যাবে, যেখানে যুদ্ধ বা আন্দোলনের শুরুতেই তার সর্বাধিনায়ক বন্দি হচ্ছেন, আন্দোলন চলাকালীন একটা বিরাট সময়ে তিনি মানুষের চোখের সামনে নেই, প্রত্যক্ষ নেতৃত্বও দিতে পারছেন না— অথচ সাধারণ মানুষের সংগ্রামস্পৃহা তাতে রুদ্ধ হচ্ছে না, তাঁরা এগিয়ে চলেছেন অভীষ্ট লাভের পথে: হতে পারে তা রাজনৈতিক স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, বর্ণবৈষম্য দূরীকরণ বা অন্য কিছু। ১৯৭১-এর বাংলাদেশ ছাড়াও ইতিহাস আরও উদাহরণ তুলে ধরে। ১৯৪২-এ ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন শুরুর লগ্নেই গ্রেফতার হন মহাত্মা গান্ধী-সহ তৎকালীন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সব সদস্য, অর্থাৎ ঘোষিত আন্দোলনের পুরোভাগের নেতারা। তার পর মাত্র দিনকতক জনগণ ছিলেন বিভ্রান্ত ও সে কারণেই অরাজক, অনতিবিলম্বে দেশ জুড়ে শুরু হয় জাতি ধর্ম বর্ণ ও আর্থ-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে মানুষের প্রতিরোধ: স্থিরলক্ষ্য, সুভাবিত। আমেরিকায় ‘সিভিল রাইটস’ আন্দোলনের অবিসংবাদিত মুখ মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের বার্মিংহাম কারাগার থেকে লেখা ১৯৬৩-র চিঠিটি পড়লে বোঝা যায় নেতা ও জনতার আশ্চর্য সম্পর্ক— জনতা সর্বাধিনায়ককে সর্বদা সামনে দেখতে চাইবে, নেতার প্রতিটি ইশারা ও নির্দেশের জন্য আকুল হয়ে থাকবে এ যেমন সত্য, তেমনই সমান সত্য নেতার অনুপস্থিতিতে জনতার মধ্যেই নেতৃত্বের স্ফুরণ। বর্ণবাদ-বিরোধী লড়াইয়ে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতের অভিযোগে একটানা সাতাশ বছর কারান্তরালে থাকতে হয়েছে নেলসন ম্যান্ডেলাকে। একটি প্রজন্মকালের চেয়েও দীর্ঘ সেই সময়ে ‘পথের সাথি’রা রাজপথে লড়াই না চালিয়ে গেলে ইতিহাস গড়া হত না তাঁর দেশেরও।

তার মানে কি নেতা নয়, জনতাই যে কোনও আন্দোলন ও যুদ্ধে প্রথম ও শেষ কথা? ইতিহাস থেকেই এমন বহু সাক্ষ্য দেওয়া যাবে যেখানে জননায়কের আগাগোড়া উপস্থিতি সত্ত্বেও প্রতিরোধ ফলপ্রসূ হয়নি, অন্তত সেই সময়ের মতো পরাজয় মেনে নিতে হয়েছে নেতা ও জনতা উভয়কেই। রাজনীতি ও মনস্তত্ত্ব, দুই পরিসরের বিশেষজ্ঞরাই বলবেন, আসল কথাটি হল জননায়কের প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা। জননায়কেরা দীর্ঘ সময় কারান্তরালে থাকা সত্ত্বেও যখন বাইরে মানুষের প্রতিরোধে ভাটা পড়ে না, তা বুঝিয়ে দেয় সেই নেতারই শক্তি— তাঁর স্বপ্ন দেখানোর ক্ষমতা, এক বৃহৎ লক্ষ্যের দিকে বিপুল মানুষকে চালিত করার ক্ষমতা। সম্পূর্ণ বিপরীত ও নেতিবাচক উদাহরণও রয়েছে ইতিহাসেই, অ্যাডল্ফ হিটলারের সর্বাধিনায়কত্বে চল্লিশের দশকে জার্মান জাতি শুধু অন্য ধর্ম ও জাতির মানুষকে ঘৃণাই করেনি, নিধনযজ্ঞে শামিল হয়েছে। এ-ও জননেতারই প্রভাব, পরিণতিটি ভিন্ন ও ভয়ঙ্কর। নেতা চোখের সামনেই থাকুন কি আড়ালে, তাঁর ভাবমূর্তিটিই হয়ে ওঠে জনসাধারণকে চালিত ও পরিচালিত করবার এক অদৃশ্য দূরনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’, ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ অথবা ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’-এর মতো ইতিহাস হয়ে ওঠা নেতৃবাক্যে ধরা আছে সর্বাধিনায়কের সেই জাদুমন্ত্র। জনতার ভূমিকা তাতে ছোট হয় না। যাঁর জন্য যুদ্ধ করা, যুদ্ধের শুরুতে সেই সেনাপতিই বন্দি হলে পদাতিক বাহিনীর ছত্রভঙ্গ হওয়ার সমূহ আশঙ্কা। বাইরে যুদ্ধ, ভিতরেও মানসিক প্রতিঘাতের মুখে তাঁদের পক্ষে পরিস্থিতির ক্রীড়নক হয়ে ওঠা অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু তাঁরাই হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের নিয়ন্তা।

Advertisement
আরও পড়ুন