অনন্তর, শীতের সকালে সমগ্র বাজার তথা বিশ্বজগৎকে কপিবৎ বলিয়া ভ্রম হয়। মুলা, পালং প্রভৃতি নানা শীতের আনাজ হইতে কপির মহিমা অবশ্য আলাদা। সংস্কৃত ভাষায় কপি অর্থে বানর— মহাবল অর্জুনের তিন ঘোড়ায় টানা রথের ধ্বজা বা পতাকায় বানরের চিত্র থাকিত, তাই তাহার নাম কপিধ্বজ। এক্ষণে সেই সব দ্রুতগামী রথ আর নাই, কিন্তু বাজারের ঝাঁকা, মুটে, ভ্যানরিকশা ও সকল ব্যাপারীই ফুলকপি, বাঁধাকপি ও ওলকপিতে কপিধ্বজ হইয়াছেন। বঙ্গ-রসনায় শীতকাল কেবল পিঠাপুলি, কেক, প্যাস্ট্রি ও নলেনগুড়ের স্বাদে আকীর্ণ নহে। খেত হইতে আনা সদ্যোজাত কপি হৃদয় জয় করিয়াছে। সেই কবে সুকুমার রায়ের নেড়া নৈনিতালের নতুন আলুর বন্দনা গাহিয়াছিল। তাহার পর হইতে লেখক, কবিদের খাইবার পাতে শীতের আনাজ আলো ছড়াইয়া চলিয়াছে। বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাসে ফুলকপির শয্যায় কইমাছের কথা আছে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই সময়ে মুলা-সহ শোলমাছ ভক্ষণ করিতে ভালবাসিতেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্য আজ ক্রমেই এই শীত-স্বাদ বিস্মৃত হইতেছে। স্বাভাবিক। বাঙালির ইতিহাস নাই, মনীষী কবেই বলিয়াছেন।
প্রসঙ্গত, কেবল লক, বেন্থাম, মিলের দর্শন আর শেক্সপিয়রের নাটক নহে, বাংলার জনপ্রিয় এই কপিও কিন্তু ঔপনিবেশিকদের অবদান। বাঙালির মঙ্গলকাব্যে কপি, বেগুন, টমেটো সঙ্গত কারণে অনুপস্থিত। চণ্ডীমঙ্গলের শিব-পার্বতীকে নানা পদ রাঁধিবার অনুরোধ করিলেও ফুলকপির শিঙাড়া বানাইতে বলেন নাই। আলু হইতে কপি, ময়দা, কালো জিরা কোনওটিই বাঙালির কৈলাস পর্বতে ছিল না। উপনিবেশে সাহেবরা যাহা যাহা আনিলেন, এবং আনিতে থাকিলেন, সেই তালিকায় একের পর এক সংযোজন: ফুলকপি, ওলকপি, বাঁধাকপি হইতে ব্রকোলি। ইহারা সকলে একই পরিবারের, ব্রাসিকা ওলেরাসিয়া নামের একটি তুচ্ছ উদ্ভিদ ইহাদের পূর্বপুরুষ। মজার বিষয়, সাহেবদের হাত ধরিয়া আসিলেও ইহারা জাতে খাঁটি ইউরোপীয় নহে। বরং ভূমধ্যসাগরের সাইপ্রাস দ্বীপে প্রচুর পরিমাণে ফলিত এই উদ্ভিদ। তথাকার ফরাসি রাজন্যবর্গের প্রয়াসে ক্রমে ইহা পশ্চিম ইউরোপে ছড়াইয়া পড়ে। ফরাসি জগৎ কেবল সুগন্ধি, গিলোটিন ও বিপ্লবের জন্য খ্যাত নহে, কপিরও যথেষ্ট অবদান। প্রথম দিকে ভূমধ্যসাগরের নিকট ইটালির জেনোয়া অঞ্চল হইতে কপি আসিত, সপ্তদশ শতকের শুরুতেও এক ফরাসি উদ্ভিদবিজ্ঞানীর আক্ষেপ, “ইটালীয়রা যাহাকে ফুলকপি বলে, তাহা এ দেশে বিশেষ হয় না। অথচ ইটালীয়দের খাওয়ার টেবিলে ওই সব্জি গৌরবজনক ভাবে অবস্থান করে।” চতুর্দশ লুইয়ের রাজত্বে আনাজটি জাতে উঠিল, রাজপ্রাসাদের টেবিলে ঠাঁই পাইল। অতঃপর ১৮২২ সালে ব্রিটিশদের সৌজন্যে ভারতে আগমন। অর্থাৎ উপনিবেশ কেবল ইউরোপ-ভূমি হইতেই নূতন সম্পদ লাভ করে নাই, অন্যান্য উপনিবেশের সম্পদের সহিত পরিচিত হইতেছিল, তাহাদের আপন করিয়া লইতেছিল। ইহা এক ভিন্ন বিশ্বায়নের কাহিনি, যাহা তুলনায় স্বল্পচর্চিত ও কম গৌরবান্বিত। কিন্তু ভুলিলে চলিবে না, যে ‘আলু-গোবি’ হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের হৃদয় জয় করিয়াছে, তাহা আর্যাবর্তের নিজস্ব ধন নহে। ভুলিলে চলিবে না, বিশ্ব কত রূপে ভারতের নিকট ধরা দিয়াছে, এবং ভারত দুই হাত বাড়াইয়া সেই সব নূতনকে আপন করিয়ােছ।
ভারতে প্রবেশ করিবার পর আবার আলাদা ইতিহাস। বাঙালি প্রথমেই ফুলকপি, বাঁধাকপির ভক্ত হয় নাই, প্রথমে বিহারই কপির ভারতজয়ের রাস্তা প্রশস্ত করিয়াছিল। বাঙালি কপি অপেক্ষা তাহার শাকপাতা, ডাঁটা খাইতে পছন্দ করিত: প্রমাণ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’। বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ অভিধানকার ফুলকপি হইতে ওলকপিকে নির্বিচারে পুষ্পশাক বলিয়াছেন, বাঁধাকপিকে পত্রশাক বিশেষ। ব্যসন ও রন্ধন প্রকৃত প্রস্তাবে সংস্কৃতির অন্যান্য চিহ্নের ন্যায়। উহারা অনড় থাকে না, বদলাইয়া যায়। অবশ্য ফুলকপি লইয়া কথা বলিতেই হয় যদি, আরও একটি বিষয় গুরুতর। ইহারা কিন্তু নিজের সত্তাটি বিসর্জন না দিয়াও অন্যের সঙ্গে মিশিতে পারে। প্রায় সর্বদাই তাহার ফুলগুলি অটুট রাখিয়া কড়াইয়ে দিতে হয়। কিন্তু পদভেদে স্বাদভেদে খামতি পড়ে না। অর্থাৎ এই আনাজটির উৎস বিদেশে, ঐতিহ্যটি সর্বভারতীয়, এবং বাঙালি ধাঁচটি অনবদ্য। পশ্চিমি হাতফেরতা হইয়াও ইহার দেশীয় রূপ বিচিত্রধর্মী, গভীরসঞ্চারী! কপি বলিতে যাঁহারা শুধু বানর বুঝিতেন, তাঁহারা কি ভাবিতে পারিয়াছিলেন, কালক্রমে এই বৈচিত্রসমৃদ্ধিতে পৌঁছানো যাইবে?
যৎকিঞ্চিৎ
‘সায়েন্স’। ‘ফিকশন’ নয়। সুইৎজ়ারল্যান্ডের সংস্থা তৈরি করেছে অভিনব কফিন-যন্ত্র ‘সার্কো’, ঢুকে শুয়ে পড়লে মুহূর্তে কফিনের ভিতর অক্সিজেন ফুরোবে, জীবনও মুড়োবে। এক মিনিটেই মৃত্যু, যন্ত্রণাহীন। আইনি হুড়কো পেরিয়ে এখন তা স্রেফ নতুন বছরে ‘বাজারে’ আসার অপেক্ষা। এ দিকে মহা শোরগোল: এ তো দেখা যাচ্ছে উন্নততর গ্যাস চেম্বার ঘরে ঘরে নাগালে আনার ব্যবস্থা! কিছু মানুষ আবার অন্য বিপদে। ‘সুইৎজ়ারল্যান্ড বেড়াতে যাচ্ছি’ বললেই লোকে সন্দেহের চোখে দেখবে না তো?