মেয়েদের অর্থ সহায়তাই যথেষ্ট নহে, প্রয়োজন তাহাদের কর্মসংস্থান। কথাটি মনে করাইয়াছে বিশ্বব্যাঙ্ক। ব্যাঙ্কের পরামর্শ, ডিজিটাল প্রযুক্তি-সহ নানা কারিগরি দক্ষতায় প্রশিক্ষিত করিতে হইবে মহিলাদের, পাশাপাশি জীবনের মান উন্নত করিবার উপায় সম্পর্কেও তাহাদের অবহিত করিতে হইবে। এই সুপারিশ অপ্রত্যাশিত নহে— জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ অর্থের উপযোগিতা বাড়াইতে এমন নানা পরামর্শ বিশেষজ্ঞরা দিয়া থাকেন। তবু কথাগুলি গুরুত্বের সহিত বিবেচনা করা প্রয়োজন। গত কয়েক বৎসরে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করিবার জন্য পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে বিবিধ সহায়তা প্রকল্পের সংখ্যা বাড়িয়াছে, মাথাপিছু অনুদানের পরিমাণও বাড়িয়াছে। তাহার প্রয়োজন রহিয়াছে, সন্দেহ নাই। অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরাও বার বার জানাইয়াছেন, অতিমারি-জনিত পরিস্থিতিতে অর্থের অভাবে সাধারণ নাগরিকের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাইলে মানব উন্নয়ন ব্যাহত হইবে। তাই রাজকোষ হইতে নাগরিকের হাতে সরাসরি আর্থিক সহায়তা পৌঁছাইবার প্রয়োজন রহিয়াছে। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমেই বিবিধ আর্থ-সামাজিক গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা এবং অনুদান পৌঁছাইবার কাজটি করা হইয়া থাকে, তাই কেন্দ্র ও রাজ্য, উভয়ই নূতন নূতন প্রকল্পের সূচনা করিয়াছে। কিন্তু তাহাতে কয়েকটি উদ্বেগ তৈরি হইয়াছে। প্রথম উদ্বেগটি একেবারে গোড়ার কথা। এত অর্থ আসিবে কোথা হইতে? এতখানি সম্পন্নতা কি রাজকোষের আছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, এই ধরনের নীতির বহুলপ্রচারে নাগরিক কি ক্রমশ অনুদান-নির্ভর হইয়া আপন উদ্যোগ ও দক্ষতা হারাইয়া ফেলিবে? এবং তৃতীয় প্রশ্ন, রাজকোষের অর্থ কি বাস্তবিকই নাগরিকের জীবনের মান বর্ধিত করিতেছে?
বিবিধ অনুদান আর্থিক সুরক্ষা ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করিবার উপযুক্ত জমি প্রস্তুত করিতেছে, না কি ভস্মে ঘি ঢালিবার মতো অর্থহীন অপচয়ে পর্যবসিত হইতেছে, এই বিচার প্রতি পদক্ষেপে প্রয়োজন। অর্থের জোগানের উপায় সন্ধান করিতে গিয়াই রাজ্যকে বিশ্বব্যাঙ্কের দ্বারস্থ হইতে হইয়াছে। মূল কথাটি সরল— অনুদানের অর্থ বিতরণ করিয়াই সরকারের কর্তব্য শেষ হয় না। উৎপাদন ও বিপণনের যে সকল পরিকাঠামোগত উন্নতি করিলে অধিক লোক অধিক রোজগারের সংস্থান করিতে পারে, সেইগুলি প্রতিনিয়ত করিতে হইবে সরকারকে। তরুণ-তরুণীদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা সৃষ্টি তাহার অংশ, কিন্তু তাহাতেই সরকারের কাজ সীমাবদ্ধ নহে। অসংগঠিত ক্ষেত্রই ভারতের অধিকাংশ দরিদ্র ও স্বল্পবিত্ত মানুষের উপার্জন জুগাইয়া থাকে, তাই তাহার উৎপাদনশীলতা বাড়াইতে হইবে। তাহার জন্য আইনি ব্যবস্থা হইতে মাল পরিবহণ, পণ্যের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ হইতে চাহিদা-সংক্রান্ত তথ্যের প্রচার, এমন বিবিধ বৃহৎ ও ক্ষুদ্র বিষয়ে নানা সংস্কার প্রয়োজন।
এই সকল সংস্কার যে দীর্ঘ দিন উপেক্ষিত হইয়াছে, তাহাই নহে; অনুদানের প্রকল্পগুলির সংখ্যা বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি ব্যবস্থাও অনুদানের তালিকা নির্মাণ ও অর্থপ্রদানে প্রায় সম্পূর্ণ নিয়োজিত হইয়া পড়িয়াছে। কৃষি, হস্তশিল্প, ক্ষুদ্র শিল্পে নিযুক্তদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শদান, উৎপাদন বৃদ্ধি বা বিপণনের সুবিধার সঙ্গে সরকারি আধিকারিকদের সম্পর্ক ক্রমশই ক্ষীণ হইতেছে। ইহার ফলে অনুদানের টাকা পাইয়াও রোজগার বাড়াইবার, জীবনের মান উন্নয়নের সুযোগ অধরা থাকিতেছে বহু মানুষের কাছে। অমর্ত্য সেন মনে করাইয়াছিলেন, বস্তু অথবা সুবিধার বণ্টন করিলেই ন্যায় করা হইল, এমন নহে। সেই বস্তু লইয়া ব্যক্তি কী করিতে পারিল, তাহার আশা-আকাঙ্ক্ষার সাধন হইল কি না, তাহাই প্রধান বিবেচ্য। অতএব অনুদান বিতরণ উপায়, লক্ষ্য জীবনের মানোন্নয়ন। তাহার দ্বারাই অনুদানের সার্থকতা বিচার হইবে।