Israel-Palestine Conflict

ধ্বংসের এক বছর

যে কুতার্কিকরা যুক্তি দেন যে হামাসই এই যুদ্ধ শুরু করেছিল, তাঁদের উদ্দেশে একটিই কথা বলার থাকে। কোনও জঙ্গি গোষ্ঠীর আক্রমণ এবং কোনও সামগ্রিক সমাজের উপর এক আগ্রাসী রাষ্ট্রের লাগাতার আক্রমণ, দু’টি ঠিক এক কথা নয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:২৬

তিনশো পঁয়ষট্টি দিন, এক বছর। আরও কত দিন লাগবে প্যালেস্টাইন নামক ভূমিখণ্ডকে জনহীন ভগ্নস্তূপে পরিণত করতে? এ কোনও আলঙ্কারিক প্রশ্ন নয়। গাজ়া ভূখণ্ড তথা প্যালেস্টাইনকে ধ্বংস করার লক্ষ্য সরাসরি ভাবেই ঘোষণা করেছে ইজ়রায়েল, এবং তাদের সেই ঘোষণা সস্নেহ ও সশস্ত্র, প্রশ্রয় ও আশ্রয় পেয়েছে পশ্চিমি বিশ্বের তাবৎ শক্তিশালী রাষ্ট্রের কাছে। গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে এক অবিশ্বাস্য রক্তক্ষয়ী প্রাণধ্বংসী অভিযান চলছে এই অঞ্চলে। অনেকেই একে যুদ্ধ বলছেন, কিন্তু সামান্য বিবেচনাই বলে দেয়, যা ঘটছে তাকে আক্রমণ-অভিযান বলাই সঙ্গত যে হেতু যুদ্ধ বস্তুটা সাধারণত দ্বিপাক্ষিক হয়ে থাকে। এবং এই অভিযান সম্ভবত চলবে যত দিন না ইজ়রায়েল ওই প্রাথমিক লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। ইতিমধ্যে অবশ্যই নানা রকম কূটনীতি ও রাজনীতির প্যাঁচে মূল বিষয়টিকে মেঘাচ্ছন্ন করে রাখা হচ্ছে, যাতে প্রকৃত কথাটি বিশ্বজনমনকে বেশি আলোড়িত করতে না পারে। নতুবা, এ কি এক আশ্চর্য রকমের অভাবনীয় ঘটনা নয় যে, তিনশো পঁয়ষট্টি দিন ধরে বিশ্বের এতগুলি দেশ ইজ়রায়েল ও তার প্রধান মিত্র আমেরিকাকে যুদ্ধ থামানোর অনুরোধ, উপরোধ, পরামর্শ কিছুই তেমন পাঠাতে পারেনি? বরং অনেকেই ইজ়রায়েলের সাহায্যে প্রবৃত্ত হয়েছে, এমনকি ভারতও? এক বছর আগে হামাস জঙ্গি গোষ্ঠীর ইজ়রায়েলের উপর ভয়ঙ্কর হানা ও তার উত্তরে ইজ়রায়েলের ভয়ঙ্করতর যুদ্ধ তথা গণহত্যার পর আজ আন্তর্জাতিক দুনিয়া এই সত্যের মুখোমুখি— কেবল ইজ়রায়েল ও আমেরিকা নয়, রাষ্ট্রপুঞ্জ-সহ প্রায় সব দেশই এক মহাপরাধে অপরাধী। সে অপরাধ বিস্মরণের, নৈঃশব্দ্যের ও অপারগতার। নিরপরাধ, অসহায়, নিহত ও আহত, ধ্বস্ত ও ত্রস্ত সকল প্যালেস্টাইনি মানুষকে স্মরণ করে এই অপরাধ মেনে নেওয়ার দিনটি আজ— ৭ অক্টোবর।

Advertisement

যে কুতার্কিকরা যুক্তি দেন যে হামাসই এই যুদ্ধ শুরু করেছিল, তাঁদের উদ্দেশে একটিই কথা বলার থাকে। কোনও জঙ্গি গোষ্ঠীর আক্রমণ এবং কোনও সামগ্রিক সমাজের উপর এক আগ্রাসী রাষ্ট্রের লাগাতার আক্রমণ, দু’টি ঠিক এক কথা নয়। কোনও জঙ্গি গোষ্ঠীর মোকাবিলা করা আর কোনও আবদ্ধ অসহায় অসামরিক জনগোষ্ঠীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করা— এক কথা নয়, হতে পারে না। তদুপরি, সে কাজ যদি ইজ়রায়েলের মতো সামরিক ভাবে অতীব দক্ষ ও সমৃদ্ধ দেশ করতে থাকে, এবং তাকে অনবরত নেপথ্য সহায়তাদানে উন্মুখ থাকে আমেরিকাযুক্তরাষ্ট্রের মতো সুপারপাওয়ার, কোনও যুক্তিতেই তাকে সমর্থন করা অসম্ভব।

এক বছর পূর্তির মহাক্ষণে অবশ্য এই সংঘর্ষ আর গাজ়া ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ নেই। ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে এখন সমগ্র পশ্চিম এশিয়া জুড়ে বইছে যুদ্ধের ঝোড়ো কালো মেঘ। ইরান বা লেবাননের আকাশে ছুটে আসছে বোমারু বিমান, হিজ়বুল্লা নামক জঙ্গি সংগঠনকে নির্বংশ করার উদ্দেশ্যে এই সব দেশের উপর বোমাবর্ষ‌ণ শুরু হয়েছে, হতাহত হচ্ছেন বহু নিরীহ মানুষ। পশ্চিম এশিয়ার ইসলামি সন্ত্রাসী কার্যক্রম একটি অতীব ভয়াল বিষয়, তাকে নির্মূল করার পরিকল্পনা জরুরি। কিন্তু তাই বলে মুড়ি-মিছরির মতো নিরপরাধ মানুষকে বোমায় বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিয়ে সন্ত্রাসের বিপদ কমানো হচ্ছে না বাড়ানো হচ্ছে, সেই কথা কি প্রণিধান সহকারে ভেবেছেন এই রাষ্ট্রনেতারা? মনস্তাত্ত্বিক হিংসার নিরাময় না হলে ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন কিংবা বৃহত্তর পশ্চিম এশিয়ার ভাগ্যপরিবর্তনের আশা নেই। নেতানিয়াহুর সম্প্রতি-প্রচারিত বিবৃতিই বলে দেয়, সেই মানস-হিংসার পরিমাণ কমার কোনও আশা নেই, জঙ্গিদের মধ্যে তো নয়ই, জঙ্গিদমনকারীদের মধ্যেও নয়। আরও হয়তো অনেক দিন এমন হিংসার বিস্ফোরণ দেখতে হবে। এক অন্তহীন হিংস্রতা ও বিপরীতে এক নিঃসীম নিস্পৃহতা, এটাই হয়তো একবিংশ শতকের বিশ্বায়ন।

আরও পড়ুন
Advertisement